মে ৫, ২০২৪

পৃথিবীর সব দেশেই পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি রয়েছে। তবে কোথাও বিচার হয় আর কোথাও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় ছাড়া পেয়ে যায়, অথবা অর্থ কেলেঙ্কারির তুলনায় লোক দেখানো জরিমানা করে ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়।

ভারতের পুঁজিবাজারের এমন একজন শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ব্যক্তির নাম হর্ষদ মেহতা। একাধিক ব্যাংকের একাংশের মদতে বেআইনি ট্রেডিংয়ের অভিযোগ ছিল হর্ষদ মেহতার বিরুদ্ধে। ১৯৯২ সালে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে গ্রেফতার হন হর্ষদ মেহতা। মেহতার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২৭টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তবে মাত্র চারটি মামলায় আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মেহতার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি মামলায় ৯ বছর ধরে শুনানি চলেছিল। ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন হর্ষদ মেহতা। হর্ষদ মেহতা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এনেছিলেন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সাংবাদিক সুচেতা দালাল। পরবর্তীতে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার।

হর্ষদ মেহতা

হর্ষদ মেহতা ১৯৯২ নিরাপত্তা জালিয়াতি বিস্তারিত

১৯৯২ সালের নিরাপত্তা জালিয়াতি ছিল ভারতের স্টক মার্কেটে মিঃ হর্ষদ মেহতা দ্বারা সংঘটিত একটি পদ্ধতিগত জালিয়াতি। মেহতা যখন এই জালিয়াতি করেছিলেন, তখন একজন ব্যক্তির স্টক কেনার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ন্যূনতম ব্যালেন্স বজায় রাখার প্রয়োজন ছিল না এবং স্টক বিক্রি করার জন্য ব্রোকারের একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকার প্রয়োজন ছিল না। এইভাবে, ভারতীয় স্টক মার্কেটের এই ঘাটতি এবং ফাঁকফোকরগুলি হর্ষদ মেহতাকে তার সুবিধার জন্য সিস্টেমের এই ফাঁকগুলি ব্যবহার করতে সাহায্য করেছিল, যা ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং পুরো সিকিউরিটিজ সিস্টেমকে নাড়া দিয়েছিল।

হর্ষদ মেহতা জাল ব্যাঙ্কের রসিদ ব্যবহার করে ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্ক, এসবিআই (স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া) এবং ইউকো ব্যাঙ্ক সহ বেশ কয়েকটি সুপরিচিত ব্যাঙ্ক থেকে স্টকের একটি ডাইভার্সন তৈরি করেছিলেন এবং অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

মেহতা বিএসই (বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ) থেকে স্টক কেনার জন্য ১ বিলিয়নেরও বেশি জালিয়াতি করেছিলেন, যার ফলে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ৩৫০০ – ৪০০০ কোটি টাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এবং ভারতীয় স্টক মার্কেট মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিল।

কথিত আছে, মেহতা তার ঋণ মেটাতে এবং ক্লায়েন্টদের ফেরত দেওয়ার জন্য প্রায় তার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন যতক্ষণ না টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সুচেতা দালাল হর্ষদ মেহতা এবং তার সমস্ত বেআইনি কাজগুলি উদঘাটন করেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলার পর, হর্ষদ মেহতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য সমস্ত সম্ভাব্য উপায় চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন। ১৯৯২ কেলেঙ্কারিটি স্টক মার্কেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারীতে পরিণত হয়েছিল এবং এই ধরনের প্রথা আর কখনো না ঘটবে তা নিশ্চিত করার জন্য; আরবিআই ভারতে বহু সংস্কার প্রবর্তন করেন।

সুচেতা দালাল (হর্ষদ মেহতা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এনেছিলেন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সাংবাদিক সুচেতা দালাল। পরবর্তীতে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার।)

ভারতের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িত আরেক আলোচিত ব্যক্তির নাম সব্রত রায়, সাহারা ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা।

(ভারতের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সাহারা গ্রুপের প্রধান সুব্রত রায়ের মুখে কালি ছিটিয়ে দেয় এক ব্যক্তি)

বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা কোম্পানি ইতিহাসে কম নয়। বেশির ভাগ সময়ই মূল ক্ষতিটা হয় বিনিয়োগকারীদের। হাজার হাজার টাকা লগ্নি করে ফলাফলের খাতা হয় শূন্য। তবে অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি শক্ত হাতে লেগে থাকে, তবে অপরাধী সংস্থা খুব সহজে পার পায় না। তেমনটায় ঘটে ভারতের সাহারা গ্রুপের সঙ্গে। সাহারা গ্রুপের কেলেঙ্কারি প্রথম ধরা পড়ে ২০০৯ সালে। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দিতে কাজ করে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

সাহারা স্ক্যাম নামে পরিচিত এই বিখ্যাত কেলেঙ্কারি প্রধানত সাহারা গ্রুপের দুটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ কোম্পানি দুটি হলো সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট করপোরেশন লিমিটেড (এসআইআরইসিএল) ও সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড (এসএইচআইসিএল)। আর তাদের এই কেলেঙ্কারির বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (এসইবিআই) রাডারে। তবে সাহারা স্ক্যামের ঘটনা বুঝতে হলে প্রথমে যে দুটি বিষয়ে জানতে হবে, তা হলো আইপিও ও ডিআরএইচপি। যখন কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারের মাধ্যমে প্রথমবার অর্থ সংগ্রহ করে, তখন তাকে বলা হয় প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও)। ভারতে আইপিও ছাড়ার আগে কোম্পানিটিকে এসইবিআইয়ের থেকে অনুমোদন নিতে হয়। আর এই উদ্দেশ্যে কোম্পানিটিকে একটি ড্রাফট রেড হেরিং প্রসপেক্টাস (ডিআরএইচপি) এসইবিআইতে জমা দিতে হয়। এটি একটি কোম্পানির একধরনের বায়োডাটা, যাতে একটি কোম্পানির প্রায় সব বিবরণই উল্লেখ থাকে। এরপর এসইবিআই কোম্পানিটির ডিআরএইচপি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয় আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হবে কি না।

সাহারা বনাম এসইবিআই

২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম সাহারা প্রাইম সিটি (সাহারা গ্রুপের একটি কোম্পানি) আইপিওর জন্য এসইবিআইয়ের কাছে ডিআরএইচপি জমা দেয়। ডিআরএইচপি বিশ্লেষণ করার সময়, এসইবিআই সাহারা গ্রুপের দুটি সংস্থার (সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট করপোরেশন ও সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন) তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি শনাক্ত করে। তারা দেখতে পায়, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহ করে নিজেদের সম্পদ গড়ে তুলেছে সাহারা।

এর মধ্যে এসইবিআই অভিযোগ পায়, সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট করপোরেশন ও সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন ঐচ্ছিক রূপান্তরযোগ্য ডিবেঞ্চার (ওএফসিডি) প্রদান করছে এবং বেআইনিভাবে তহবিল সংগ্রহ করছে। এসইবিআইয়ের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়। এসইবিআই এই দুটি কোম্পানির ওপর তদন্ত শুরু করে এবং তাদের তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে সাহারা গ্রুপের কাছে ব্যাখ্যা চায়। তদন্তে এসইবিআই জানতে পারে, ইতিমধ্যে ওই ওএফসিডির মাধ্যমে প্রায় ৩ কোটি বিনিয়োগকারী থেকে ২৪ হাজার কোটি রুপি তুলে নিয়েছে সাহারার অধীনে থাকা ওই দুই কোম্পানি। বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি রুপি ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এসইবিআই ও সাহারার মধ্যে আইনি লড়াই শুরু হয়।

সাহারা দাবি করে, এই বন্ডগুলো হাইব্রিড পণ্য, যা এসইবিআইয়ের নিয়ন্ত্রণে নয়, করপোরেটবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যেখান থেকে সাহারা এর দুটি কোম্পানির অনুমতি নিয়েছে। তবে এসইবিআই সাহারার ওই ব্যাখ্যা আমলে না নিয়ে দুটি কোম্পানিকে ওএফসিডির মাধ্যমে অর্থ তোলা বন্ধ করতে এবং ১৫ শতাংশ সুদে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এসইবিআইয়ের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সাহারা প্রথমে এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এসইবিআইয়ের এ বিষয়ের কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ করে। তবে এর মাত্র পাঁচ মাস পরে ২০১১ সালের এপ্রিলে এলাহাবাদ হাইকোর্ট উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে। মামলাটি অবশেষে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আসে। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, সাহারা গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলো থেকে বেআইনিভাবে ২৬ হাজার কোটি রুপি (সুদ যোগ হওয়ার পর) তুলেছে। লাখ লাখ মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা না রেখে সাহারাকে টাকা দিয়েছেন। সাহারা তাঁদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট সাহারার ওই দুটি কোম্পানির ওএফডিআই হোল্ডারদের টাকা সুদের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে এসইবিআইতে জমা দিতে বলেন। সেই সঙ্গে এসইবিআইয়ের কাছে ওএফসিডি ধারকদের সমস্ত বিবরণ জমা দিতেও বলা হয়, যাতে এসইবিআই নিশ্চিত করতে পারে যে অর্থ বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছেছে। ২০১৩ সালের মধ্যে সাহারা ১২৭টি ট্রাকে ওএফডিআই হোল্ডারদের বিশদ বিবরণ এসইবিআই অফিসে পাঠায়। তবে এসইবিআই দ্বিতীয় ব্যাচের ফাইল প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ ট্রাকগুলো অফিস সময়ের পরে এসইবিআইয়ের কাছে পৌঁছেছিল। ওই ব্যাচে ২৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীর তথ্য ছিল। এসইবিআই বুঝতে পারে যে ফাইলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে সঠিক এবং সম্পূর্ণ বিবরণ নেই। মামলাটি মুদ্রা পাচার মামলার দিকে মোড় নিতে শুরু করে। এর মধ্যে সাহারা তিন মাসের মধ্যে ১৫ শতাংশ সুদসহ এসইবিআইতে অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হয়।

সুপ্রিম কোর্ট সাহারা গ্রুপকে তিন কিস্তিতে অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাহারা প্রথম কিস্তি পরিশোধ করে ৫ হাজার ১২০ কোটি রুপি। আর দাবি করে যে তারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীদের অর্থ প্রদান করেছে। এর পেছনে সাহারার যুক্তি ছিল দুই থেকে আড়াই কোটি বিনিয়োগকারীর মধ্যে কেবল ৪ হাজার ৬০০ জন অর্থ দাবি করতে এগিয়ে এসেছিলেন। সাহারা ইন্ডিয়ার যুক্তি ছিল যেহেতু অন্য বিনিয়োগকারীরা দাবি করতে এগিয়ে আসেননি, তার অর্থ দাঁড়ায় তাঁদের অর্থ ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে। তবে এটি প্রমাণ করতে বলা হলে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি সাহারা গ্রুপ। এমনকি তারা শোধ করা অর্থের কোনো আয়ের উৎসও উল্লেখ করেনি। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট ও এসইবিআই উভয়ই এটিকে অর্থ পাচারের মামলা হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে। ফলে সম্পদসহ সাহারা ইন্ডিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে শুরু করে এসইবিআই।

সাহারার প্রতিপত্তি

ঘটনার এ পর্যায়ে এসে সাহারার প্রতিপত্তি কিছুটা তুলে ধরা যাক। ২০০৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় রেলওয়ের পর জনশক্তির দিক দিয়ে সাহারা গ্রুপ দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। ভারতে তখন সাহারার পাঁচ হাজারের বেশি অফিস ছিল। প্রায় ১৪ লাখ মানুষ ওই কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
১৯৭৬ সালে প্রথম সাহারা ফিন্যান্স নামে এক চিট ফান্ড কোম্পানিতে যোগ দেন এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত রায়। পরে তিনি কোম্পানিটি কিনে নেন। ১৯৭৮ সালে তিনি কোম্পানির আর্থিক মডেলটি বদলে দেন। নব্বইয়ের দশকে সুব্রত রায় সাহারার সদর দপ্তর তৈরি করেন লক্ষ্ণৌতে। ১৯৯২ সালে সুব্রত রায় ‘রাষ্ট্রীয় সাহারা’ নামে এক সংবাদপত্র চালু করেন। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে পুনের কাছে শুরু করেন অ্যাম্বি ভ্যালি প্রকল্প। মহারাষ্ট্রের লোনাভালা থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপর ৮ হাজার ৯০০ একর জমিতে গড়ে তোলা উপশহর অ্যাম্বি ভ্যালিকে বলা হয় সাহারার মুকুটের সেরা রত্ন। ২০০০ সালে চালু হয় সাহারা টিভি। লন্ডন ও নিউইয়র্কে বেশ কয়েকটি নামকরা হোটেলেরও মালিক তিনি। সাহারা ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষকতাও করে। আবাসন প্রকল্প দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে আর্থিক খাত, অবকাঠামো, সংবাদমাধ্যম, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, স্বাস্থ্যসেবা, পণ্য উৎপাদন, ক্রীড়া ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাহারার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। তবে ২০০৯ সালে এসে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল জনপ্রিয় সাহারা গ্রুপ যে এক ঘোলাটে ব্যবসা করে গেছে, তা প্রকাশ পেতে শুরু করে।

গ্রেপ্তার হন সুব্রত রায়

আবার ফিরে আসি সাহারা স্ক্যামে। নেটফ্লিক্সের ‘ব্যাড বয় বিলিয়নিয়ারস’ সিরিজে জায়গা নিয়ে রেখেছে সুব্রত রায়ের আলোচিত এই মামলা। এ যেন আসলেই এক সিনেমার গল্প। ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পুলিশ ভারতের লক্ষ্ণৌ শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান সুব্রত রায়কে। মার্চে তাঁকে সাহারা গ্রুপের অন্য দুই পরিচালকের সঙ্গে তিহার কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৫ সালে সাহারার মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করে এসইবিআই। ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে জামিন দেন। তিনি তাঁর সম্পদের একটি অংশ বিক্রি করার অনুমতিও পান।

এসইবিআই যেভাবে অর্থ আদায় করে যাচ্ছে সাহারা থেকে

জামিনের শুনানিতে সুব্রত রায়ের আইনজীবী কপিল সিবল সেপ্টেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য আরও ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সাহারা গ্রুপ দাবি করে, তাদের হেনস্তা করতে ইচ্ছাকৃতভাবে ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত সুদ চাপিয়েছে এসইবিআই। সাহারার দাবি, বিনিয়োগকারীদের আগেই পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে তারা। তা সত্ত্বেও দুবার করে টাকা চাওয়া হচ্ছে। তবে আদালত প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হননি। আদালত সুব্রত রায়কে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও ৩০০ কোটি রুপি দেওয়ার নির্দেশ দেন। তা না হলে আবারও গ্রেপ্তার হতে হবে—এমনটা বলা হয়। জামিন হয় সুব্রত রায়ের। ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্যারোলে মুক্ত রয়েছেন ভারতের সাহারা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুব্রত রায়। কয়েক কিস্তিতে মোট টাকার একটি বড় অংশ আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হলেও বাকি অর্থ পরিশোধের জন্য ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময় চায় সাহারা গ্রুপ। কিন্তু তা নাকচ করে দিয়ে ২০১৭ সালে সাহারার অ্যাম্বি ভ্যালি নিলামে তোলার আদেশ দেন আদালত। এখন পর্যন্ত এই কাণ্ডে মোট ১৫ হাজার কোটি টাকা জমা করেছে সাহারা। গত বছর এসইবিআই জানায়, গত নয় বছরে সাহারার দুই সংস্থার দেনা সুদে–আসলে বেড়ে ৬২ হাজার ৬০০ কোটি রুপি হয়েছে। জেলমুক্ত থাকতে হলে সুব্রত রায়কে সেই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। যদিও এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি সর্বোচ্চ আদালত।

সাহারার বিনিয়োগকারীরা কি অর্থ ফেরত পেয়েছেন

সাহারার বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১২৯ কোটি রুপি ফেরত দিয়েছে এসইবিআই। এসইবিআই-সাহারা রিফান্ড অ্যাকাউন্টে আমানতের পরিমাণ এখন প্রায় ২৩ হাজার কোটি রুপি। তবে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়েও এখন পর্যন্ত তার থেকে খুব সামান্য অর্থই বিনিয়োগকারীদের পরিশোধ করতে পেরেছে এসইবিআই।

তবে এখানে একটি প্রশ্ন এনেছিলেন অনেক বিশ্লেষক, সুব্রত রায় ২০১৪ সালে বিনিয়োগকারীদের পাওনা পরিশোধ করে সহজেই জামিন নিতে পারতেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন দীর্ঘ দুই বছর কারাগারে ছিলেন, তা অবাক করে বিশ্লেষকদের। কারণ, সুব্রত রায়ের ব্যক্তিগত সম্পদ এবং বিনিয়োগকারীদের পাওনার মধ্যে বিশাল ব্যবধান ছিল। ২০১৬ সালের সুব্রত রায়ের আইনজীবী কপিল সিবলও সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জামিনের আবেদনের পক্ষে যুক্তি দেখানোর সময় বলেছিলেন, সাহারার মালিক পালিয়ে যাবেন না, কারণ তাঁর প্রচুর সম্পদ রয়েছে। তবে কেন তিনি তা করেননি, তা অজানা বিশ্লেষকদের। উল্লেখ্য, সুব্রত রায়ের সম্পদ ছিল বলেই বিনিয়োগকারীদের তা ফিরে পাওয়ার আশা ছিল। যাঁদের সম্পদ নেই, তাঁদের নিয়েই বিপদ।

ভারতে বেআইনিভাবে বাজার থেকে তোলা অর্থ লগ্নিকারীদের কাছে না ফেরানোর অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সহারা। সাহারার ছিল নানা ডিপোজিট স্কিমের ব্যবসা। সাহারা মাইনর, সাহারা সুপার বা সাহারা এমআইএস—এ ধরনের নানা ডিপোজিট স্কিমের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত সাহারা ইন্ডিয়া ফিন্যান্সিয়াল করপোরেশন। এই ডিপোজিট স্কিমের কোনোটির কিস্তি এক রুপিও ছিল। বিপুল জনসংখ্যার দেশ ভারতে এভাবে অর্থ সংগ্রহের চেয়ে সহজ পথ আর কী হতে পারে। বিষয়টা ছিল অনেকটা বাংলাদেশের ডেসটিনির অর্থ সংগ্রহের মতোই। মিল আছে ইভ্যালি–কাণ্ডের সঙ্গেও। তবে এসইবিআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় এই বিশাল প্রতারণা আটকে ফেলা সম্ভব হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনায় সমস্ত প্রমাণ থাকলেও নানা ধরনের আইনি ফাঁকফোকর ও অর্থের ক্ষমতার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সর্বশেষ বলা যা, এই কেস হলো এমন একটি উদাহরণ—নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি শক্ত হয়, তবে কোনো অপরাধী জয়ী হতে পারে না।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *