নভেম্বর ১৬, ২০২৪

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পণ্য ও সেবায় বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারে নতুন পণ্য হিসেবে ডেরিভেটিভস মার্কেটের আওতায় ফরেক্স বা বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। দেশে বৈদেশিক বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে ‘কারেন্সি ডেরিভেটিভস’ চালু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।

নতুন এ মার্কেটপ্লেস চালু হলে পুঁজিবাজারের আকার অনেক বাড়বে এবং সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলবে। একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ ডেরিভেটিভস মার্কেট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিএসইতে ফরেক্স ট্রেডিং চালুর ক্ষেত্রে সার্বিক সহাযোগিতা করছে তাদেরই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবিজি লিমিটেড। তারা এ বিষয়ে সিএসইকে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। তবে, এ প্ল্যাটফর্ম চালু করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা পেলে দেশে দ্রুত ফরেক্স মার্কেট চালু করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও বিনিময় হার নির্ধারণের বাজারকে ফরেক্স বোঝায়। যেখানে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ক্রয়, বিক্রয় এবং বিনিময় করতে পারে। দেশে ডেরিভেটভস মার্কেটের অংশ হিসেবে কারেন্সি ডেরিভেটিভসের আওতায় এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করতে চায় সিএসইসি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ফরেক্স ট্রেডিং নিষিদ্ধ। এ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হলে যারা বিভিন্ন পন্থায় বৈদেশি মুদ্রা নিয়ে ব্যবসা করেন, তারা বিশাল সুবিধা পাবেন। এছাড়া, বর্তমানে যারা অবৈধভাবে বা অনুমতি ব্যতিত ফরেক্স ট্রেডিং করছেন, তারা প্ল্যাটফর্মটিতে লেনদেন করার বৈধতা পাবেন।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে ডেরিভিটিভসের মার্কেটের আওতায় ইউএসডি কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ট্রেডে হয়ে থাকে। এটা ব্রোকারেজ হাউজে লেনদেন হয়ে থাকে। ভারতের পুঁজিবাজারে প্রায় ৬০ শতাংশ টার্নওভার আসে ডেরিভিটিভস মার্কেট থেকে।

সিএসই সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ডেরিভেটিভ মার্কেট চালু করার জন্য লাইসেন্স পেয়েছে। সেহেতু, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট কারেন্সি ডেরিভেটভস আমব্রেলার মধ্যে আছে। কিন্তু, এটা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর অনুযায়ী ডেরিভেটিভস মার্কেটে কৃষিপণ্য, বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ও এনার্জির ফিউচার ট্রেড করার বিধান রয়েছে। কিন্তু, আইনে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ডেরিভেটিভ বা এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড কারেন্সি ট্রেডের কথা উল্লেখ করা নেই। বিএসইসিকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ সংশোধনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ খাতে একটা বিশাল সম্ভাবনা আছে। ডলারের প্রাইস যদি হেইজিং করার সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হবে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে, ভার্চুয়াল সম্পদ ও মুদ্রা লেনদেন নিষিদ্ধ করে এগুলো বিনিময়/স্থানান্তর/বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা ও এ সংক্রান্ত যেকোনো ধরনের কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান হতে বিরত থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। গত বছরের ১২ অক্টোবর ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনায় বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন বিদেশি ভার্চুয়াল ভ্যাসেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ভিএএসপি) তাদের ওয়েবসাইট/অ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যরত কোনো কোনো তফসিলি ব্যাংকের গ্রাহক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল কারেন্সি, ক্রিপ্টো কারেন্সি, ফরেন কারেন্সি ইত্যাদির লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, পুনঃবিক্রয়, পিটুপি নিময়/স্থানান্তর/বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ভার্চুয়াল সম্পদ ও ভার্চুয়াল মুদ্রার (ভার্চুয়াল কারেন্সি/ক্রিপ্টো কারেন্সি) লেনদেন এবং তাদের বিনিময়/স্থানান্তর/বাণিজ্য কার্যক্রমের কারণে সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি পরিহারের লক্ষ্যে গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ভ্যাসেট পুনঃবিক্রয়, পারসন টু পারসন (পিটুপি) বিনিময়/স্থানানতর/বাণিজ্য সংক্রান্ত কার্যক্রম অথবা এরূপ যেকোনো ধরনের কার্যে সহায়তা প্রদান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়ে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনপূর্বক মনিটরিং কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর 8৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে গত ৫ বছরের ভার্চুয়াল মুদ্রা ও অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ (এসএআর) বাড়ছে। বিএফআইইউ বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম ভার্চুয়াল মুদ্রা ও অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বয়স, নারী-পুরুষ, পেশা অনুযায়ী চিত্র পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘পুঁজিবাজারে নতুন প্রোডাক্ট হিসেবে ফাইন্যান্সিয়াল ডেরিভিটিভসের আওতায় ফরেক্স বা বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন চালু করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি-তে প্রস্তাব দিয়েছি। মূলত দেশে বৈদেশিক বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কমোডিটি ডেরিভেটিভস মার্কেট চালু করার ক্ষেত্রে বিএসইসির আইনের সম্মতি রয়েছে। তবে, ফাইন্যান্সিয়াল ডেরিভিটিভস বা কারেন্সি ডেরিভেটিভস চালু করার এক্ষেত্রে আইনে কিছুই বলা নেই। তাই, এ বিষয়ে বিএসইসির আইনি সহায়তা ও সম্মতি চাওয়া হয়েছে। এ কাজে সিএসইকে সার্বিক সহযোগিতা করছে এবিজি লিমিটেড। তারা ফরেক্স চালুর বিষয়ে অনেক আগ্রহী। তারা এ বিষয়ে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে নতুন প্রোডাক্ট হিসেবে ফাইন্যান্সিয়াল ডেরিভিটিভসেরে আওতায় ফরেক্স বা বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন করার বিষয়ে সিএসই একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি। কমোডি ও ডেরিভেটিভসের আওতায় এটা আসবে।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফরেক্স বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বর্তমানের বাংলাদেশে একটি সিন্ডিকেট ফরেক্স মার্কেট নিয়ে অনৈতিকভাবে ব্যবসা করছে। এটা যখন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত হবে, তখন এ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে।  বৈধভাবে ব্যবসা করা সম্ভব হবে,  বাংলাদেশি মুদ্রা ফরেক্স মার্কেটে যুক্ত হবে। তখন তা আন্তর্জাতিক মার্কেটের সঙ্গে রিয়েলটাইমে লেনদেন হবে, ফলে, দেশে ডলার বা অন্যান্য মুদ্রার দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে অবৈধ লেনদেন কমে যাবে । মোট কথা, ফরেক্স মার্কেট চালু হলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে।’

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...