গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এখন যে সংঘর্ষ আর সংঘাত চলছে, তার জন্য মূলত দায়ী ‘মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার’খ্যাত ইসরাইল। কোনো আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করছে না দেশটি। গত ছয় মাসে গাজায় একে একে ৩৪ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার।
ইসরাইলের আগ্রাসনে এখনো গাজায় প্রতিদিন ধ্বংস্তূপের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। জাতিসংঘ বলছে, ফিলিস্তিনে গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মেরামত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে লাগবে প্রায় ১৪ বছর।
গাজায় ইসরাইলের বর্বরতার ভয়াবহতা বোঝার জন্য খান ইউনিসে পাওয়া গণকবরের নিদর্শনই যথেষ্ট। কচুকাটার মতো মানুষ মেরেছে ইসরাইলি সেনারা। ওই গণকবর থেকে সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বর্তমানে গাজা উপত্যকার জনসংখ্যা ২৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষই খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
কয়েকদিন আগে ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাতও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। প্রথমে ইরানে হামলা করে ইসরাইল। সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনসুলার ভবনে হামলা করা হয়। এতে ইরানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরাইলেও হামলা করে ইরান। এতে ইরানের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় ইসরাইলের।
এদিকে রোববার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গাজার কসাই আখ্যা দিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। তিনি নেতানিয়াহুকে জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের রাফায় অভিযান চালিয়েছে ইসরাইল। এ অভিযানের আগে দেশটিকে বারণ করেছিল পুরো বিশ্ব। তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ডাকেও সাড়া না দিয়ে রাফায় হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। তখন বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরাইলি নেতারা বিপথগামী হয়ে গেছে।
‘উগ্র রাষ্ট্র’ বলতে কী বুঝায়?
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উগ্র রাষ্ট্র বলতে এমন রাষ্ট্রকে বুঝায়, যে রাষ্ট্র কোনো আন্তর্জাতিক আইন মানে না। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিকভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। যদিও কোন দেশকে এই তকমা দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করে পশ্চিমা রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর। বিল ক্লিনটনের সময়কাল থেকে এই তকমার প্রচলন শুরু হয়েছে।
২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পর মার্কিনিরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। যদিও এর মাধ্যমেই মূলত পশ্চিমাবিরোধী যেসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মানত না তাদেরকে উগ্র রাষ্ট্র খেতাব দেওয়া হতো।
বিশ্বায়নের এ যুগে বর্তমানে ইসরাইলকেও উগ্র রাষ্ট্র তকমায় ভূষিত করা সময়ের দাবি। কারণ দেশটি গোটা মধ্যেপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলার মূল হোতা। গাজায় গণহত্যা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক আইনের সব সীমা লঙ্ঘন করেছে দেশটি।
কেন ইসরাইলকে ‘উগ্র রাষ্ট্র’ তকমা দেওয়া উচিত?
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের উদ্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের উদ্দেশ্য একই। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সব রাষ্ট্র আইন মানতে ও তৈরি করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এসব আইনের মর্যাদা অনবরত ক্ষুণ্ন করছে ইসরাইল।
গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরাইল গাজায় হামলা শুরু করে। এ পর্যন্ত এ হামলায় ১৪ হাজার শিশুর প্রাণ গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অক্সফাম বলছে, একবিংশ শতাব্দীতে যত সংঘাত হয়েছে, এর মধ্যে গাজায় প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
গাজায় এ অভিযানে স্বাস্থ্য সুবিধার উপর ৯০০ হামলা চালিয়েছে। মেডিকেলের প্রায় ৭০০ কর্মীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। গাজার প্রতি ৩৬ হাসপাতালের ২৬টি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
গাজার আল-শিফা হাসপাতালে হামাসের সামরিক ঘাঁটি আছে, এ দাবি করে সেখানে অভিযান চালায় ইসরাইল। দুই সপ্তাহের অভিযানে সেখানকার সব আধুনিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
অভিযানের পর যখন সেখান থেকে ইসরাইলি সেনারা প্রস্থান করছিল তখন দেখা যায়, লাশের মুণ্ড থেকে মাংস ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কাক। এরপর গণকবরে মিলল শত শত মানুষের লাশের সন্ধান।
না খেয়ে থাকা মানুষের সহায়তায় কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরাও ছাড় পাননি ইসরাইলের নৃশংসতার কবল থেকে। গত ছয় মাসে এমন প্রায় ২০০ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
কোন কোন আইন লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল?
জেনেভা কনভেনশনের ৭৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক ও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা যাবে না। কিন্তু দেখা গেছে, ইসরাইলের হামলায় নিহতদের প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক। সুপরিকল্পিতভাবে তারা সাংবাদিকদেরও হত্যা করেছে। এমনকি সাংবাদিকদের পরিবারও রক্ষা পায়নি। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মারা গেছেন গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে যেন একটি যুদ্ধ বাঁধাতে মরিয়া ইসরাইল। গত ৭ অক্টোবরের পর ৪ হাজার ৭৩৩ বার লেবাননে হামলা করেছে দেশটি।
ইরানের কনসুলে হামলা করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর্পস (আইআরডিসি) এর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিকে হত্যা করে দেশটি। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যু হয়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতেরও গুরুত্ব দেয় না ইসরাইল। গত ডিসেম্বরে হামাস-ইসরাইলের যুদ্ধবিরতির পক্ষে উত্থাপিত প্রস্তাবে ১৫৩টি দেশ ভোট দেয়। এতে মাত্র ১০টি দেশ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তবুও যুদ্ধবিরতিতে রাজি ছিল না ইসরাইল।
গত ২৫ মার্চ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসন থামাতে উত্থাপিত একটি রেজল্যুশনে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ভোট দিয়েছে। বাকী ১৪টি দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তবুও থামছে না দেশটি।
সম্প্রতি কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, স্পেন এবং বেলজিয়ামের মতো দেশগুলোও ইসরাইলের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেছে। এর দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহের অর্থ দাড়ায় ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ আটকে দেওয়া।