ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে সোনার বার কিনে দেশে এনে পাচার করছে চোরাকারবারিরা। একই সঙ্গে বিদেশে শ্রমিকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ বিকাশ-নগদের মাধ্যমে দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠানো হচ্ছে। শ্রমিকরাও হুন্ডি ব্যবসা ও সোনা চোরাচালানে জড়িত বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনার শুল্ক আমদানি করা সোনার চেয়ে কম হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারিরা। ফলে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিরা বৈধ উপায়ে সোনার বার বাংলাদেশে এনে আবার পাচার করছে। প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ টন সোনার চাহিদা থাকলেও প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার সোনার বার এবং অলংকার লাগেজ নিয়মে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু অভিবাসীদের পাঠানোর কথা ছিল টাকা। টাকা না এসে সোনা আসায় দেশে ডলার সংকট গভীর হয়েছে বলে জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, ব্যাগেজ রুলস-২০১৬-এর আওতায় সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফেরার সময় একজন ১১৬ গ্রাম ওজনের দুটি সোনার বার নিয়ে আসতে পারে। এই সুযোগে চোরাকারবারিরা কিছু অর্থ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিক ও ভ্রমণকারীদের হাতে তুলে দেয় সোনার বার। শ্রমিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ দেশে তাদের আত্মীয়স্বজনের বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। জানা গেছে, যারা নিয়মিত বাহক হিসেবে সোনার বার আনার কাজ করছে তাদের যাতায়াতে বিমানের টিকিট, থাকা-খাওয়ার খরচও বহন করে চোরাকারবারিরা। এভাবে বছরের পর বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে সোনার বার বাংলাদেশে এসে বৈধ হয়ে আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে।
প্রবাসী শ্রমিক ও সোনার বার বাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক শ্রমিক ছয় মাস আগে থেকে দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তারা দেশে ফেরার সময় দুটি সোনার বার নিয়ে আসে। বিমানবন্দরে শুল্ক পরিশোধ করার পরও দুটি বারের জন্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বাড়তি পায় শ্রমিকরা। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো শ্রমিকদের মতামত বিদেশে বিকাশ-নগদের সাইনবোর্ড টানিয়ে টাকা পাঠানো বন্ধ করা ও সোনার বার নেওয়ার বিধান বাতিল করলে রেমিট্যান্স বাড়বে। যতদিন সোনার বার নেওয়ার বিধান চালু থাকবে ততদিন রেমিট্যান্স বাড়বে না।
সৌদি আরবের দাম্মাম প্রবাসী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রিয়াল নিয়ে সোনার বার কিনছে। আরও দেশে আত্মীয়স্বজনের বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। যতদিন সোনা চোরাকারবার বন্ধ হবে না ততদনি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়বে না বলেও জানান তিনি।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী শামীম মোল্লা বলেন, সোনা চোরাকারবারিরা শ্রমিকদের বাসা, রুমে গিয়ে ডলার সংগ্রহ করছে। প্রবাসীদের বাড়িতে গিয়ে অথবা বিকাশ-নগদে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেই ডলার দিয়ে তারা সোনার বার কিনে বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছে।

নিয়মিত দুবাই থেকে সোনার বার এনে বিক্রি করেন এমন একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, বিদেশ থেকে আনা প্রতিটি সোনার বারের জন্য সরকার ২০ হাজার টাকা রাজস্ব পায়। শ্রমিকরা এই সুযোগে সোনার বার নিয়ে আসার কারণে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমান চলাচল। এতে সোনা চোরাকারবারিদের যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমে রেমিট্যান্স বেড়ে যায়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২৫৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশে কভিড-১৯ লকডাউন থাকা সত্ত্বেও অভিবাসী শ্রমিকরা ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ সময়ে তারা ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার প্রেরণ করেছেন।

রেমিট্যান্সের এই উত্থান দেখে ২০২০ সালের আগস্টে এক অনুষ্ঠানে আত্মতৃপ্ত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তখন তিনি বলেছিলেন, দেশে গত দুই মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আমাদের আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদের পূর্বাভাসের অনেকটাই মিল রয়েছে এখন। বিমান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমতে শুরু করেছে রেমিট্যান্স। সোনা চোরাকারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে সোনার বার কিনে পাচার করছে এবং দেশে অভিবাসীর আতীয়স্বজনের বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করে দিচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিক ও ভ্রমণকারীরা ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৭৯১ কেজি সোনা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। শুধু ২০২২ সালেই ৪৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার ৫২ হাজার ১৯৫ কেজি সোনা আনা হয়েছে। সোনা থেকে সরকার ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা শুল্ক পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, একজন প্রতিবার বাংলাদেশে আসার সময় কতবার সোনার বার নিয়ে আসতে পারবে তার কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় চোরাকারবারিরা একই ব্যক্তিকে বারবার ব্যবহার করে সোনা নিয়ে আসছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (সিআইআইডি) কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনার কর ব্যবসার জন্য আমদানি করা সোনার চেয়ে কম। এ কারণেই চোরাকারবারিরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ২৩৪ গ্রাম সোনা নিয়ে আসা ব্যক্তিরা শুল্ক বাবদ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে, কিন্তু একই পরিমাণ সোনা কেউ আমদানি করলে কর দিতে হয় ৭০ হাজার টাকা।

একজন কতবার সোনা নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে তার একটি সীমা নির্ধারণ করতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কয়েক বছর ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের বছরে দুবার এবং পর্যটকদের বছরে একবার দুটি সোনার বার আনার অনুমতি দেওয়ার বিধান করার পাশাপাশি এটি তাদের ট্যাক্স ফাইলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি না করায় চোরাকারবারিরা বৈধভাবে সোনা এনে পাচার করছে। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে সোনা আসায় রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কিছু মানুষ কেবল দুবাই এবং ওমানে ভ্রমণ করে চোরাকারবারিদের বাহকের ভূমিকা পালন করছে। সোনার বার ছাড়াও, তারা মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য পণ্যও নিয়ে আসে। তারা বিমানের টিকিট এবং বার আনার বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০১৯-২০২২ সালে দেশে আসা সোনার প্রায় ৯১ শতাংশ বার। এর প্রায় ৭৪ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, ২০ শতাংশ সৌদি আরব থেকে এবং বাকি সব বাহরাইন, ওমান এবং সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে। তবে বৈধ-অবৈধভাবে দেশে যে পরিমাণ সোনা আসে তার একটা বড় অংশ পাচার হয়ে যায়। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সোনা আমদানি কঠোর হওয়ার কারণে চোরাচালানিরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে।

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...