ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

‘কা আমরা মানব না’ আসামের রাজপথে আবার সেই পুরনো স্লোগান। ফের জ্বলছে সেই প্রতিবাদের আগুন। ধরনা, বিক্ষোভে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি, রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে, পোড়ানো হচ্ছে সিএএ (কা)-এর বিধি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছিল আসাম। পুলিশের গুলিতে মৃতু্য হয়েছিল পাঁচজনের। এবার সেই পরিস্থিতি হয়নি এখনো। কিন্তু দেশের সাধারণ নির্বাচনের মুখে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শিবির, বিজেপি-বিরোধী সব রাজনৈতিক দল অন্দোলনের পথ নিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য, জাতিগত বৈষম্যমূলক আইনের প্রতিবাদ করা এবং বিজেপি সরকারকে উত্খাত করা। ফলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে।

বিধি প্রণয়নের পর সোমবার সন্ধ্যা থেকে আসামসহ পুরো ভারতে বলবত্ হয়েছে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ)। ফলে জাতিগত বিভাজন আরও পরস্ফিুট হয়েছে রাজ্যে। ভবিষ্যতের অসুরক্ষিতবোধ করছে আসামের মূল স্রোতের অসমিয়া সমাজ। ভাষা-ঐতিহ্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে সামাজিক আক্রোশের মুখে পড়েছে হিন্দু বাঙালিরা। কারণ, তাদের লক্ষ্য করেই সিএএ কার্যকরী করা হয়েছে। আবার আসামের মুসলমান সমাজও আতঙ্কিত। কারণ, নাগরিকত্ব দিয়ে হিন্দুদের সুরক্ষিত করে বহিষ্কারের খাঁড়া তাদের ওপরই ঝুলিয়ে রেখেছে বিজেপি সরকার।

তিন প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সংসদে গৃহীত হয় ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ)। আইন অনুযায়ী, ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আগত হিন্দু, শিখ, বেৌদ্ধ, জৈন, খ্রষ্টিান ও পার্সিরা নাগরিকত্ব পেতে পারেন।
আইন প্রণয়নের পর চার বছর ধরে সবকিছু স্থবির ছিল, তবে সাধারণ নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে আইনের বিধি জারি করে সরকারি উদ্যোগেই সমাজে ধর্মীয় মেরূকরণের প্রচষ্টো চালানো হচ্ছে। হিন্দু ভোটে ফায়দা তোলাই শাসক বিজেপির মূল লক্ষ্য।

আসলে সিএএ-কে ঘিরে একশ্রেণির লোকের মধ্যে নাগরিকত্ব লাভের মিথ্যা আশা জাগানো হচ্ছে। অন্যদিকে আসামের মূল বাসিন্দা অসমিয়াদের মধ্যে ছড়ানো হচ্ছে ভাষা-সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার ভুল আতঙ্ক। ফলে আসামের সমাজে হিন্দু-মুসলিম, অসমিয়া-বাঙালিদের মধ্যে প্রবল মেরূকরণ ঘটেছে।

অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের বদ্ধমূল ধারণা, সিএএ-এর ফলে আসামে বসবাসকারী প্রচুরসংখ্যক অবৈধ’ বাংলাদেশি হিন্দুরা যেমন নাগরিকত্ব পাবেন, তেমনই ভারতীয় নাগরিকত্বের আশায় বাংলাদেশ থেকেও চলে আসবেন লাখ লাখ হিন্দু। এর ফলে বাংলাভাষীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়ে অসমিয়া ভাষার বিলোপ ঘটবে অচিরেই।

কিন্তু ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর আসামে আগত বাঙালি হিন্দু, মুসলমান সবাই বিদেশি। নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসিও প্রস্তুত করা হয়েছে এরই ভিত্তিতে। অথচ দেশের অন্য কোনো রাজ্যে নেই বিদেশি শনাক্তকরণের এই প্রক্রিয়া।
১৯৭১ সালের পর আগত বলে কাউকে সন্দেহ হলে পুলিশ নোটিশ ধরায়, ‘ডি’ (ডাউটফুল) চিহ্ন সেঁটে দেওয়া হয় ভোটার তালিকায়, বিদেশি ট্রাইবু্যনালে বিচার হয় নাগরিকত্বের।

আশির দশকে ছাত্র সংস্থা আসু’র ( অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ,এএএসইউ) নেতৃত্বে সংঘটিত বিদেশি খেদা, আড়ালে Èবঙাল খেদা’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বিদেশি শনাক্তকরণের এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে আসামে।

কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর আগত ছয়টি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব দেওয়াই এখন মোদি সরকারের লক্ষ্য। এতে লঙ্ঘিত হচ্ছে আসাম চুক্তিও। আন্দোলনকারীদের দাবি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর আসামে আগত বাঙালি হিন্দু, মুসলমান সবাই বিদেশি। সেখানে ধর্মের ভিত্তিতে একশ্রেণির লোককে কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধানও যার অনুমতি দেয় না। কিন্তু আইনকানুন, প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে আরএসএস, বিজেপি নেতাদের একই সুর বিশ্বের যেখানেই হিন্দুরা নির্যাতিত হবেন, ভারতে তাদের আশ্রয় দিতেই হবে।

সিএএ কার্যকরী হওয়ায় আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন অসুরক্ষিত আসামের মুসলমানরাও। কারণ, মুসলিম-বিরোধিতার পথ নেওয়া বিজেপি সরকার এবার বহিষ্কারের খঁাড়া নামিয়ে আনতে পারে তাদের ওপর।

নাগরিকপঞ্জির প্রক্রিয়ায় হেনস্তা হওয়ার মতো ফের নাগরিকত্বের পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়া হতে পারে মুসলমানদের। ফলে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প খোলা নেই।

অবশ্য ভোটের ময়দানে বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলতে আন্দোলনে উসকানি রয়েছে কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধীদেরও। ফলে হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পূর্ণ আশঙ্কা রয়েছে আসামে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...