সিনেমার নাম ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে’, যাতে অভিনয় করেছেন রানি মুখার্জি। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাকে কেন্দ্র করেই সামনে চলে এসেছে নরওয়ে আর ভারতের মধ্যে এক ধরনের তীব্র ‘সাংস্কৃতিক সংঘাত’।
দিল্লিতে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হান্স জেকব ফ্রাইডেনলান্ড রীতিমতো টুইট করে ও খবরের কাগজে অপ-এড লিখে দাবি করেছেন, এই ছবিটিতে নরওয়ে সম্পর্কে বহু তথ্যগত অসঙ্গতি আছে এবং ওতে যা দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
অন্য দিকে, বাস্তবে যার জীবনের ঘটনা নিয়ে ছবিটি তৈরি সেই সাগরিকা চক্রবর্তী পাল্টা দাবি করেছেন, নরওয়ে সরকার মোটেই সত্যি কথা বলছে না এবং আজ পর্যন্ত তারা এই ঘটনাটি নিয়ে মিথ্যে রটনা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় বারো বছর আগে নরওয়ের স্ট্যাভাঙ্গার শহরে তখন সেখানকার বাসিন্দা সাগরিকা চক্রবর্তীর দুই শিশুসন্তানকে বাবা-মা’র কাছ থেকে আচমকা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিয়েছিল নরওয়ের শিশু সুরক্ষা বিভাগ।
পরে ভারত সরকারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে ও নরওয়ের আদালতে দীর্ঘ শুনানির শেষে প্রায় বছরখানেক পর ওই বাচ্চা দুটিকে পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তারা ভারতে সাগরিকা চক্রবর্তীর কাছেই মানুষ হয়েছে।
তার কোল থেকে বাচ্চাদের অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়ার জন্য আজ পর্যন্ত নরওয়ে সরকার কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি বলেও জানিয়েছেন সাগরিকা চক্রবর্তী।
সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর নরওয়ের রাষ্ট্রদূত তার দেশের হয়ে যে সাফাই দিয়েছেন তার মূল কথাটা হলো – নরওয়েতে ‘পেরেন্টিং ট্র্যাডিশন’ বা সন্তানকে প্রতিপালনের পদ্ধতি ভারতের চেয়ে আলাদা হতে পারে, কিন্তু মানবিক আবেগ বা মায়ের ভালবাসায় কোনো ফারাক নেই।
‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে’-তে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ভারতীয় বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিজেদের বিছানাতেই নিয়ে শোন বা অনেক সময় নিজে হাতে করে খাইয়ে দেন, এটা নরওয়ের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এই অভ্যাসগুলোকে তারা ‘শিশু নির্যাতনে’র (চাইল্ড অ্যাবিউজ) সমতুল্য বলে মনে করেছেন। আর এ কারণেই সিনেমায় রানি মুখার্জি অভিনীত মায়ের চরিত্রটির কাছ থেকে (ছবিতে যিনি সাগরিকা চক্রবর্তীর ভূমিকায়) তার দুই বাচ্চাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে দেখানো হয়েছে।
নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ফ্রাইডেনলান্ড এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, এই ঘটনায় সাংস্কৃতিক পার্থক্যটাই প্রধান ফ্যাক্টর ছিল বলে সিনেমাতে যা তুলে ধরা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি বাচ্চাদের হাত দিয়ে খাওয়ানো কিংবা এক বিছানায় নিয়ে শোওয়াটা নরওয়েতে কোনো বাচ্চাকে অল্টারনেটিভ কেয়ারে দেওয়ার কারণ হতেই পারে না।”
নিজের তিন সন্তানকে মানুষ করার দৃষ্টান্ত দিয়ে ওই কূটনীতিবিদ আরও জানিয়েছেন, তার বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তখন তিনি নিজেও তাদের বহুবার হাতে করে খাইয়ে দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন- আমিও রাতে শোওয়ার সময় তাদের বেডটাইম স্টোরি শোনাতাম, জড়িয়ে ধরে আদর করতাম এবং তারাও আমাদের সঙ্গে একই বিছানাতেই শুত।
বাবা-মা যদি হঠাৎ করে একদিন কোনো কারণে বাচ্চার গালে চড় মেরে বসেন (‘অ্যান অকেশনাল স্ল্যাপ’), তাহলেও সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নেওয়া হয় না – বরং শিশু কল্যাণ বিভাগ তাদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে থাকে বলে রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন।
এদিকে সিনেমার নির্মাতারা বলছেন, এখানে মোটেও মনগড়া কিছু দেখানো হয়নি, বরং নরওয়েতে তথাকথিত ‘চাইল্ড প্রোটেকশন সিস্টেম’টি যে কত ভুলে ভরা সে দিকেই দিকনির্দেশ করা হয়েছে।
তবে ভারতে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত একটি বলিউড মুভির বক্তব্য নিয়ে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাচ্ছেন – এ ঘটনা প্রায় নজিরবিহীন বলা যেতে পারে।
সূত্র : বিবিসি।