নভেম্বর ১৪, ২০২৪

সর্বস্তরের জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে এপ্রিল মাসে এসে সর্বজনীন নিবন্ধনের সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। গতকাল সোমবার জাতীয় সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন। এর পরপরই আবেদন শুরু হয়ে যায়। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর এরই মধ্যে আট মাস পার হয়েছে। আট মাস পরে এসে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ স্পর্শ করল।

এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের একটি নীতিমালা করার কথা থাকলেও এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য বিনিয়োগ নীতিমালা শিগগির চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।

প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা এই চার স্কিম নিয়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন চালু করে সরকার। পরবর্তী সময়ে সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালু করার ঘোষণা দেয়া হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে এই স্কিম কার্যকর হবে।

সর্বজনীন পেনশনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে মাঠ প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং মাঠ প্রশাসনকে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিভাগভিত্তিক মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। ফলে কমিশনার, জেলাপ্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে যথাক্রমে বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক নিবন্ধন মনিটরিং ও বাস্তবায়ন করছেন।

বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বজনীন পেনশন মেলা ও কর্মশালার আয়োজন করে সব শ্রেণি-পেশার জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯ এপ্রিল রাজশাহীতে বিভাগীয় পেনশন মেলা ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অবশিষ্ট সাত বিভাগে বিভাগীয় মেলা অনুষ্ঠিত হবে। বিতরণের জন্য মাঠ প্রশাসনের কাছে এরই মধ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক ফ্লায়ার বুকলেট পাঠানো হয়েছে এবং তা অনাহত আছে। এছাড়া সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমে ইউডিসি (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারস) উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে আজ নিবন্ধন সংখ্যার মাইলফলক এক লাখ অর্জিত হয়েছে।

জানা গেছে, এরই মধ্যে চাঁদাদাতাদের অর্থ থেকে নিরাপদ ট্রেজারি বন্ডে ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবার সহযোগিতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সর্বজনীন পেনশনের ধারণা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত সর্বজনীন পেনশন স্কিম নাগরিকদের বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ, যা সব নাগরিকের অবসরকালীন আর্থিক মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ একটি অধিকতর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন নিবন্ধন সংখ্য এক লাখ স্পর্শ করে। বিকাল ৫টায় নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৩৩৮ জন। নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দরিদ্র মানুষ, যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। অপরদিকে সব থেকে কম নিবন্ধন করেছেন প্রবাসীরা।

সূত্রটি জানিয়েছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্ন করা এক লাখ এক হাজার ৩৩৮ জন এরই মধ্যে ৫২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন। চাঁদা বাবদ জমা পড়া টাকা থেকে এরই মধ্যে প্রায় ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে ট্রেজারি বন্ডে।

বর্তমানে চালু থাকা চার স্কিমে চাঁদা পরিশোধকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ৩৩৮ জন। আর তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৩৮ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। নিবন্ধন সম্পন্ন করে সব থেকে বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে এরই মধ্যে চাঁদা জমা পড়েছে ২৪ কোটি ২০ লাখ ছয় হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনে এখন পর্যন্ত যে চাঁদা জমা পড়েছে, তার ৪৬ দশমিক ২০ শতাংশ জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৮৪ জন।

অপরদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনকারীদের মধ্যে সব থেকে বেশি দরিদ্র মানুষ, যাদের বর্তমান আয় সীমা বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এই শ্রেণির মানুষের জন্য চালু হয়েছে সমতা স্কিম। এই স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ৫৪ হাজার ৪৫৫ জন। তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ সাত কোটি ২৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধকারীদের ৫৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। এই স্কিমের মাসিক চাঁদার হার এক হাজার টাকা। এর মধ্যে স্কিম গ্রহণকারী চাঁদা দেবেন ৫০০ টাকা এবং বাকি ৫০০ টাকা দেবে সরকার।

চাঁদা দেয়া ও নিবন্ধন করা দুই দিক থেকেই সবার নিচে রয়েছে প্রবাসীরা। বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য চালু করা হয়েছে প্রবাস স্কিম। এই স্কিম গ্রহণ করে এরই মধ্যে চাঁদা দিয়েছেন ৬৩৩ জন। তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ তিন কোটি পাঁচ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ নিবন্ধনকারীদের মাত্র দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবাসী। আর মোট জমা পড়া চাঁদার ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ এসেছে প্রবাসীদের কাছ থেকে।

চাঁদা দেয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি, যেমনÑকৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি প্রভৃতি পেশার ব্যক্তিরা। তাদের জন্য চালু করা হয়েছে সুরক্ষা স্কিম। এই স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন ৩১ হাজার ৪৬৬ জন। তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ ১৭ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ মোট চাঁদার ৩৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এসেছে এই স্কিমের মাধ্যমে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনারের নমিনি পেনশন স্কিম গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বৎসর চাঁদা দেয়ার আগেই মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তা নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...