মে ২০, ২০২৪

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী দিনেও উন্নয়নের হাতছানি রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে পারেনি বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষি, গার্মেন্টস এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে খাতগুলো। দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টিহীনতা দূর, শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ, বিভিন্ন অপরাধ কমানো এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে খাতগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশকে আরও এগিয়ে নিতে সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে। এছাড়া পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর কৃষিতে এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে গত ১৫ বছরে পোলট্রি, গবাদিপশু এবং মাছ চাষে বিপ্লব হয়েছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ সময় পাট রপ্তানি করে দেশটি অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। বিশ্বে পলিপ্রোপাইলিন যুগ আসার পর পাটপণ্যের চাহিদা দ্রুত হ্রাস পায়, কিন্তু সেই শূন্যস্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নেয় তৈরি পোশাক খাত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সব চাইতে বেশি অবদান এই তৈরি পোশাক খাতেরই। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের এই শিল্পকে বর্তমানে উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুকরণ করছে। স্বাধীনতার পরে যে শিল্প আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে তার একমাত্র মাধ্যম কিন্তু এই পোশাক শিল্পই। বিশ্বের বুকে নিজেদের কঠোর শ্রম ও উৎপাদন দক্ষতা দেখাতে পারার প্রমাণ মেলে এই শিল্পের মাধ্যমে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)।

স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। একটি অতি জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরও বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম)।’

স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. আর. পারকিনসন ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তা হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর যে কোন দেশ উন্নতি করতে পারবে।’

সেসব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন অনেক বিবেচনাতেই বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়গান শোনা যায়। সমৃদ্ধির বহু নামে বাংলাদেশকে পরিচিতি দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে।

ঈর্ষণীয় এসব অর্জনের উচ্চতার সবচেয়ে বড় পরিমাপের পরিষ্কার ধারণা উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। বিশ্বের নীতিনির্ধারণী এই আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেছে। স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য এখন উৎপাদন করতে পারছে দেশ।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অর্থনীতির পালা বদলের চিত্র সহজেই বোঝা যায় দেশটির অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ সব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬২৯ কোটি ডলার, মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ ডলার, রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। সে সময় রিজার্ভ ছিল ১১০ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২২৬ কোটি ডলার, রাজস্ব আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা আর দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

৫১ বছর রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২১-২২ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কেটি ডলারে, আর রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অবদান রেখে চলেছে। গত ৫১ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গত ৫০ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। যে পাকিস্তানকে আমরা পরাজিত করেছি সেই পাকিস্তান এখন অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তবে দেশে ৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির যত পরিবর্তন ঘটেছে তার ৭৩ শতাংশ হয়েছে গত ১৩ বছরে। এরই মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বিশ্বের বুকে। এছাড়া মেট্রোরেলসহ বাকী মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে দেশের চেহারা আরও পাল্টে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ এশিয়ায় এক নম্বর দেশ হিসেবে স্বীকৃত। দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশের আশপাশেই।একেবারে শূন্য হাতে শুরু করে অদম্য বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছেছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া মোটেও সহজ নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো বাংলাদেশকে। এখন নিন্দুকেরাও আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, জন্মহার, মৃত্যুহার, শিক্ষার হার, দারিদ্র্যের হার- এমন আর্থ-সামাজিক সব সূচকেই বাংলাদেশ তার অপ্রতিরোধ্য সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় চলে এসেছে। ফলে আগামীতে বৈশ্বিক অনেক সুবিধা থাকবে না। আর এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুষম বণ্টন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *