ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনোই কাজ করার সুযোগ দেবে না বাংলাদেশ। কেননা, বাইরে কাজ করার সুযোগ মিললে রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং প্রত্যাবাসনসহ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে জোর দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রাখাইনে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

রোববার (৪ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ সফররত ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি টিক্লেমেন্টস। বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে ইউএনএইচসিআরকে এসব বার্তা দেওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনারকে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। উপ-হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চেয়েছে। ঢাকার পক্ষ থেকে কেলিকে জানানো হয়েছে, প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। আর প্রত্যাবাসন শুরু হলে সেটা অবশ্যই রোহিঙ্গাদের জানিয়ে করা হবে, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি টিক্লেমেন্টস

ইউএনএইচসিআরকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার আগেই যদি বলা হয়, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি তবে প্রত্যাবাসন শুরু করা কঠিন হয়ে পড়বে। ঢাকার পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি সংশ্লিষ্টরা বার্তা দিয়ে আসছেন, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে- মিয়ানমারে গণতন্ত্র নেই কিংবা রাখাইনের পরিবেশ এখনও প্রত্যাবাসনের অনুকূলে না, এর চেয়েও জরুরি হচ্ছে ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টদের রাখাইনে মনোযোগ দিতে হবে এবং দাতাদের কাছ থেকে অর্থায়ন জোগাড় করায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রে আরও জানা যায়, বৈঠকে রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন কমে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য দাতাদের অর্থায়ন কমে যাওয়ার বিষয়টি তুলে অর্থ জোগাড়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে ইউএনএইচসিআরকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

চলতি মাসে রোহিঙ্গাদের রেশন জনপ্রতি মাসিক ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলারে নিয়ে আসার বিষয়টি ওঠে এসেছে। এক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআরকে স্পষ্ট বার্তায় ঢাকা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনোই কাজ করার সুযোগ দেবে না বাংলাদেশ। কেননা, বাইরে কাজ করার সুযোগ মিললে রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং প্রত্যাবাসনসহ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এসেছে। রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে কমে আসছে। এ বিষয়ে ইউএনএইচসিআর দু:খ প্রকাশ করেছে। প্রত্যাবাসন ইস্যু এসেছে। আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখনও প্রত্যাবাসন নিয়ে তারিখ ঠিক হয়নি। রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তাদের না জানিয়ে পাঠানো হবে না। আর রোহিঙ্গারা রাজি হলেই প্রত্যাবাসন হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের কারিকুলামে পাঠদানের বিষয়টি বলা হয়েছে, স্কিল ডেভলাপমেন্টের কথা এসেছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেসব কাজ করছে সেটা তাদেরকে জানানো হয়েছে।

ইউএনএইচসিআরকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত গিয়ে যেন কাজ করতে পারে, সেজন্য আমাদের কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়টি সামনে আসলে মিয়ানমারের সহায়ক পরিবেশ নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কখনও সহায়ক পরিবেশ হয়েছে, এমনটা শুনিনি। সহায়ক পরিবেশ কখনও মিয়ানমারে ছিল না। এটা বলে কোনো লাভ নাই। যখন রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হবে তখন প্রত্যাবাসন হবে। জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্টদের উচিত মিয়ানমারে এনগেজমেন্ট বাড়ানো, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগী হওয়া।

কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে জাপান হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। মূলত, রোহিঙ্গাদের অর্থায়নের টাকা জোগাড় করতে টোকিও সফর করেছেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিদল।

চীনের উদ্যোগের অগ্রগতি জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে চীন প্রত্যাবাসন শুরু করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিয়ানমারও রাজি আছে। এখনও চূড়ান্ত তারিখ হয়নি। রোহিঙ্গারা রাজি হলে সবার সম্মতিতে একটা তারিখ ঠিক করা যেতে পারে।

চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। এরপর প্রায় ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...