এপ্রিল ২৮, ২০২৪

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের হাতে এসেছে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনার নথিগুলো। তারা বলছে, ‘অফিশিয়াল সেনসেটিভ’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে নথিগুলোকে। ‘যৌক্তিক সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে’ পরিবহন, খাদ্য, পানি, যোগাযোগ, জ্বালানিসহ প্রায় সব খাত অন্তত সাত দিন পর্যন্ত ‘গুরুতরভাবে ব্যাহত’ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে এসব নথিতে।

এতে আরও বলা হয়, ‘ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিস এই বলে সতর্ক করেছে যে দেশ যদি ব্ল্যাকআউটে পড়ে তবে এই শীতে চরম ঝুঁকিতে পড়বে জনগণ। সেই পরিস্থিতিতে তরুণ, বয়স্ক এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা খাদ্য, পানি এবং আশ্রয়ের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের সহায়তা পাবেন।’

হোয়াইটহলের কর্তারা এখন স্ট্রেস টেস্টিং প্রোগ্রাম-ইয়ারো নিয়ে ব্যস্ত, যেটি বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ঘটনা মোকাবিলায় গোপনীয় পরিকল্পনার অংশ। এটি নিয়ে তারা সরকারি দপ্তর এবং কাউন্সিলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক অনুশীলন করেছে।

ক্রস-গভর্নমেন্ট ব্লুপ্রিন্টটি তৈরি হয় ইউক্রেন যুদ্ধের আগে, ২০২১ সালে। ন্যাশনাল গ্রিডে বড় কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে, পরিকল্পনা ও স্থিতিস্থাপকতার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে এটি তৈরি হয়েছিল। আসন্ন শীত ঘিরে জাতীয় গ্রিডের জ্বালানি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এটির কোনো সম্পর্ক নেই।

তারপরও যুদ্ধের কারণে ব্ল্যাকআউটের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাজ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় ওই পরিকল্পনাগুলো আমলে নেয়া হয়েছে।

ব্রিটেনের ছায়া জলবায়ুমন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড বলেন, ‘সব সরকারই সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্য কনটিনজেন্সি প্ল্যানিং করে। সত্যি বলতে, দশক ধরে রক্ষণশীলদের ‘ব্যর্থ’ জ্বালানিনীতির কারণে আজ আমরা একটি দুর্বল দেশে পরিণত হয়েছি।

‘জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ কমিয়ে আনা, পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত এবং গ্যাস সঞ্চয় বন্ধ করার ফলে আজ এসবের ব্যয় আকাশে ঠেকেছে। গ্যাসের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে আমাদের ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন পুতিন।’

বন্যার ক্ষতি বা সাবস্টেশনে বজ্রপাতের বিষয়গুলোও আছে সরকারি পরিকল্পনাবিদদের পরিকল্পিত প্রযুক্তিগত ত্রুটিতে। উপসমুদ্রের বিদ্যুতের তারে যেকোনো হামলাকেও কভার করবে এই পরিকল্পনা।

সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে সোমবার নিরাপত্তামন্ত্রী টম তুগেনধাত সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। এর পরেই নথিগুলো ফাঁস হয়। যেখানে বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘আরও ঝুঁকিপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে ব্রিটেন।

পরিকল্পনায় বর্ণিত সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে অ্যানালগ এফএম রেডিওগুলোর মাধ্যমে কেবল বিবিসি রেডিও ২ এবং ৪ ব্রডকাস্টিং কাজ করবে। কারণ কয়েক ঘণ্টার জেনারেটর ব্যাকআপের কারণে স্থানীয় রেডিও স্টেশনগুলো অনিশ্চয়তায় থাকবে।

অক্টোবরে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবিসি গোপন কিছু স্ক্রিপ্ট তৈরি রেখেছে, যেগুলো আসন্ন শীতে জ্বালানি ঘাটতির কারণে ব্ল্যাকআউট বা গ্যাস সরবরাহের ক্ষতি হলে প্রকাশিত হবে।

একটি সূত্র বলেছে, ‘সরকার ইয়ারো নিয়ে কোনো প্রচার চাচ্ছে না। কারণ, তারা চায় না এটিকে ইউক্রেন, জ্বালানি সরবরাহ এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে দেখা হোক। তবে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারি। সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের সামনে সত্যিকারের উদ্বেগ অপেক্ষা করছে এবং এটি ঘটতে পারে।’

মন্ত্রিপরিষদ অফিস অবশ্য এই দাবিকে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ, তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ-সম্পর্কিত নয়।

প্রোগ্রাম ইয়ারো এমন একটি পরিস্থিতির জন্য তৈরি করা, যখন প্রচণ্ড শীতে কোনো সতর্কতা ছাড়াই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ব্যাকআপ জেনারেটরও কাজ করবে না। প্রোগ্রামটি বলছে, বিদ্যুতের চাহিদার ৬০ ভাগ ব্ল্যাকাউটের ‘২ এবং ৭ দিনের মধ্যে’ মেটানো হবে। এই দুই দিন পরিবার এবং ব্যবসায়ীরা রেশন সুবিধা পাবেন।

জ্বালানি নিয়ন্ত্রক অফগেম এবং ন্যাশনাল গ্রিডের মধ্যে একটি চুক্তিতে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহ পর বিদ্যুতের চাহিদার শতভাগ পুনরুদ্ধার করতে হবে। সরকার আশা করছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও সেই লক্ষ্য পূরণ হবে।

নথিতে বলা হয়, ‘যোগাযোগ, পরিবহন নেটওয়ার্ক, জ্বালানি সরবরাহ, খাদ্য, পানি সরবরাহসহ সব খাত এই বিপর্যয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

ইয়ারো পরিকল্পনাগুলো গত মাসে ন্যাশনাল গ্রিডের গত মাসের রূপরেখার চেয়ে আরও গুরুতর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা। যেখানে সতর্ক করা হয়, তাপমাত্রা যদি দ্রুত কমে যায় এবং রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে ব্রিটিশরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে তিন ঘণ্টা রোলিং ব্ল্যাকআউটের মুখোমুখি হতে পারে।

বিদ্যুৎ সরবরাহের জরুরি নীতির অধীনে, পরিবার এবং ব্যবসায়ীদের একটি পরিকল্পিত বিভ্রাটের ২৪ ঘণ্টার নোটিশ দেয়া হবে। পরিকল্পনাটি রোলিং ভিত্তিতে এক সপ্তাহ আগে প্রকাশ হতে পারে।

‘নিয়ম করে সংযোগ বিচ্ছিন্নের পরিকল্পনা’ সারা দেশে সমানভাবে প্রয়োগের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। শুরুতে দিনে একবার তিন ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা উচিত। কারণ, পুনরায় দিতে এক ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আসলে এটা জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতির তীব্রতার ওপর নির্ভর করবে।’

এনার্জি থিঙ্কট্যাঙ্কের রেগুলেটরি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রজেক্টের ইউরোপ ডিরেক্টর জ্যান রোসেনো বলেন, ‘একসঙ্গে অনেকগুলো হুমকি আসছে। গ্যাসের ঘাটতি, উচ্চ দাম, ফ্রান্সের পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা… এগুলো সরকারের উদ্বেগের কারণ। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পনা করা বিচক্ষণতার লক্ষণ। তবে এটা লজ্জাজনক, সংকট না এলে এসব তৈরি হয় না।’

সরকারি এক মুখপাত্র বলেন, ‘দায়িত্বশীল সরকার হিসেবে আমরা সব ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিই। অল্প সময়ে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রস্তুত ও তা প্রয়োগে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করি। এটি ধারাবাহিকভাবে চলছে। আসলে এটা আমাদের জাতীয় স্থিতিস্থাপকতা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *