মে ১৯, ২০২৪

কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ৬১ হিজরির ১০ মহররম পবিত্র আশুরার দিনে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরন করেছিলেন নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)। বড়ই নির্মম এ ইতিহাস। যে ইতিহাস সত্যের পথে জালেমের বিরুদ্ধে লড়াই করার; যে ইতিহাস রক্ত দেওয়ার। এ মর্মান্তিক ঘটনাটি এতই লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক যে, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আজো তা ভুলতে পারেনি-পারবেও না। কী ঘটেছিল সেদিন কারবালার প্রান্তরে? হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর সঙ্গে কী আচরণ করেছিল ইসলামের চির শক্র ইয়াজিদ বাহিনী?

কারবালার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আমীরে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ইয়াজিদ সমস্ত রাজ্যের (মদিনা, সিরিয়া, কুফা ইত্যাদি) শাসনভার গ্রহণ করে। তখন ইমাম হোসাইন (রা.) মদিনায় ছিলেন। ইয়াজিদের শাসনভার গ্রহণের বিষয়ে তৎকালীন সময়ের অধিকাংশ সাহাবা একমত ছিলেন না। অনেকটা অস্ত্রের জোরে সে মুসলমানদের ক্ষমতা দখল করে।
ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরের মারফত, ইমাম হোসাইন (রা.)-কে এজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে বলে। কিন্তু নবীজি (স.)-এর আদরের নাতি সাচ্চা ঈমানদার হয়ে একজন ইসলাম বিরোধী, জুলুমবাজ শাসকের আনুগত্য করা কি সম্ভব? স্বাভাবিকভাবে তিনি আনুগত্যে রাজী হননি।

তখন ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরকে নির্দেশ দেয়, বাইয়াত গ্রহণ না করলে ইমাম হোসাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে। মদিনার গভর্নর তখন ভীষণ বিপদে পড়ে যান। তিনি কিভাবে প্রিয়নবীজির নাতীকে কারাগারে নিক্ষেপ করবেন? তিনি তখন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অনুরোধ করেন মদিনা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। ইমাম হোসাইন (রা.) বাধ্য হয়ে তখন মক্কায় হিজরত করেন।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন মহানবী (স.)-এর আদর্শের প্রতীক। সেজন্যই তিনি ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করেননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চরিত্রহীন ইয়াজিদ ক্ষমতার জোরে সত্য-ন্যায়ের মসনদে চেপে বসেছিল, তখন সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল অনাচারের বিষবাষ্পে। তাকওয়া-তাহারাত ভুলে গিয়েছিল ইয়াজিদ। সে খোদার বিধানকে তোয়াক্কা না করে লিপ্ত হয়েছিল বেগানা নারীগমনে। অসহায়দের সেবার পরিবর্তে সে খুলেছিল আমোদ-প্রমোদের দুয়ার।

তার এসব কার্যকলাপে কুফার লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানালো যে, তারা মুসলিম জাহানের ইমাম হিসেবে ইয়াজিদকে নয়, হজরত হোসাইন (রা.)-কেই চায়। প্রায় ১৫০ মতান্তরে ৫০০ চিঠি পাঠিয়ে হুসাইন (রা.)-এর হাতে খেলাফতের বাইয়াত করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তারা। হুসাইন (রা.) প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা.)-কে কুফায় পাঠান। মুসলিম (রা.) কুফায় এসে দেখলেন ঘটনা সত্য। এখানকার অধিকাংশ লোকই হজরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে চান এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষে তাঁর হাতে বাইয়াত নিতে থাকেন। তিনি দ্রুত সেই খবর ইমাম হোসাইনকে (রা.)-কে জানালেন।

এদিকে এক মুনাফিকের মাধ্যমে এ খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলে সে কুফার গভর্নর নোমান বিন বাশিরকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসায়। আর বলে দিলো- ‘তুমি বসরার গভর্নর, পাশাপাশি কুফারও গভর্নর। অতএব, তুমি মুসলিম বিন আকিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করো।’ ইবনে যিয়াদ ছিল ক্ষমতালোভী ও কঠোর প্রকৃতির লোক। সে কুফায় এসেই মুসলিম (রা.)-এর হাতে বাইয়াত হওয়া অনুসারীদের থেকে নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার করা শুরু করল। এ অবস্থায় হজরত মুসলিম (রা.) সবার সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। সেদিন অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি ইশারা দিলেই গভর্নর ভবন ধূলিসাৎ হয়ে যেত। অবস্থা বেগতিক দেখে চতুর যিয়াদ ফন্দি করে বন্দিদের বলে যে, তোমরা গভর্নর ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে বলো, তারা যদি ঘেরাও প্রত্যাহার না করে তবে তোমাদের জবাই করে হত্যা করা হবে। বন্দিরা প্রাণ বাঁচাতে তা-ই করল। তাদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হজরত মুসলিম (রা.)-এর এর হাতে বাইয়াত হওয়া ৪০ হাজার অনুসারী আলোর পথ ছেড়ে দিলো। সুযোগ পেয়ে ইবনে যিয়াদ হজরত মুসলিম (রা.)-কে গ্রেফতার করে নির্মমভাবে শহীদ করে ফেলল।

শহীদ হওয়ার আগে মুসলিম (রা.) হুসাইন (রা.)-কে সতর্ক করে চিঠি লিখলেন, ‘হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফাবাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা মিথ্যা বলেছে। আমার সঙ্গেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেওয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।’ সেই চিঠি হাতে আসার আগে ৮ জিলহজ হোসাইন (রা.) কুফার উদ্দেশে রওনা শুরু করেন। স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ প্রায় ৭৩-৭৪ জনের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা শরিফ থেকে কুফার দিকে রওনা হন তিনি। পথিমধ্যে মুসলিম (রা.)-এর মৃত্যুর খবর শোনেন এবং তাঁর নতুন চিঠিটি হাতে পান। এরপর ইমাম হোসাইন (রা.) কুফার পথ পরিহার করে সিরিয়ার পথ ধরেন। উদ্দেশ্য ছিল ইয়াজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কিন্তু ইয়াজিদের সৈন্যরা তাঁর পথ রোধ করে। তারা তাঁকে কোথাও যেতে দিতে অস্বীকার করল। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে যায়। তিনি যে ভীরু নন, পিছপা হওয়ারও নন। তিনি আসাদুল্লাহিল গালিব, আলী ইবনে আবী তালিবের রক্ত। মহানবী (স.)-এর আদর্শের রক্ষাকবচ। তাই তিনি বীরবিক্রমে সামনে অগ্রসর হলেন। কুফা থেকে দু’মঞ্জিল দূরে কারবালা প্রান্তরে অসত্যের মূলোৎপাটনে সত্যের তলোয়ার ধরলেন। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।

কিন্তু হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বাহিনীর লোকজন কম হওয়ায় তাঁরা শহিদ হতে লাগলেন। অপর দিকে শত্রুরা ইমাম হোসাইনের পবিত্র বদনে বৃষ্টির মতো তীর-বর্শা নিক্ষেপ করতে থাকে। আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তে রঞ্জিত হলেন। একসময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া থেকে জমিনে পড়ে গেলেন। তখন নির্দয় সিমারের নির্দেশে জাহান্নামি সেনা ইবনে আনাস নখয়ী হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মাথা মোবারক শরীর মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পর হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শার এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছাড়াও অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল এবং তাঁর পক্ষের প্রায় ৭১-৭৩ জন শাহাদাতবরণ করেন।

কারবালার শিক্ষা
সেদিন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিলে হয়ত তিনি ও তাঁর পরিবার বেঁচে যেতেন। কিন্তু মহানবী (স.)-এর রেখে যাওয়া এই অক্ষুণ্ণ দীনকে পেতাম কি? তিনি মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়ে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জীবন দিয়ে হলেও করতে হয়। এছাড়াও অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তির অন্ধ আনুগত্য চলবে না। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো—বিশ্ব মুসলিম আজ হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) এ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আর সেজন্যই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দেখা যাচ্ছে মুসলিমদের হাহাকার, দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

কারবালার যুদ্ধে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীরা ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। কারবালায় শাহাদতের কয়েক দিন আগে থেকেই তিনি সঙ্গীদের ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন। মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তাঁর প্রতিশ্রুত পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় তার সঙ্গীরাও এ ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। এখানে রয়েছে কঠিন বিপদেও ধৈর্যধারণ, তাওয়াক্কুল ও ইমামের আনুগত্যের শিক্ষা।

যুদ্ধের আগের রাতে তিনি সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বলেন, যার ইচ্ছা সে চলে যেতে পারে। কারণ, তার সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু সঙ্গীরা আনুগত্যের শপথ করে তাকে ত্যাগ করবেন না বলে ঘোষণা দেন। মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামে এক সঙ্গী বলেন, ‘আমাকে যদি একবার হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা হয় এবং ৭০ বার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়, তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমি নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করব, যাতে কেয়ামতের ময়দানে বিশ্বনবী (সা.)-কে বলতে পারি, নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আমি আপনার বংশধরকে রক্ষার চেষ্টা করেছি!’

কারবালার ময়দানের এসব ঘটনা প্রমাণ করে হজরত হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীরা পরিপূর্ণ ঈমান নিয়েই মহান আল্লাহর আরো কাছে পৌঁছতে সচেষ্ট ছিলেন। শত্রু শিবিরকে উপদেশ দান অথবা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীরা বিন্দুমাত্র মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেননি। তাঁর শিবিরে যখন পানি ছিল, তখন তিনি শত্রুসেনাদের তৃষ্ণা মেটাতে কার্পণ্য করেননি। আবার যুদ্ধের ময়দানে চরম সাহসিকতার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর এ নমনীয়তা ও দৃঢ়তা প্রমাণ করে—তিনি অতি উচ্চ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মানবতার মুক্তি এবং মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করাই ছিল হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর উদ্দেশ্য। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তা কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না বলে ইমামের শিক্ষা মানব জাতির পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

তাই আসুন! আমরাও কারবালার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আদর্শে নিজেদের গড়ি। শপথ নিই পুরো পৃথিবীও যদি অসত্যের পক্ষ্যে নেয়, তবুও আমরা এ মিথ্যার মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়বো। এটাই যে কারবালার সুমহান শিক্ষা।

কারবালা ও আশুরা মাঝে সম্পর্ক

বর্তমানে দেখা যায় প্রায় সব মহল থেকে আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়। ইসলাম আগমনের পূর্বেও আশুরা ছিল। আশুরা শব্দটি আশারা থেকে এসেছে। এর অর্থ দশম। মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আমরা হাদিস জানতে পেরেছি, তখন মক্কার মুশরিকরা আশুরার রোজা পালন করত তেমনি ইহুদীরা হজরত মুসা (আ.) এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সওম পালন করত।

মহান আল্লাহর রাসুল (স.) আশুরার রোজা পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আশুরা পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরি ৬১ সালে কারবালার ময়দানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

মহান আল্লাহর রাসুল হজরত মুহম্মদ (স.) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোনো ভূমিকা ছিল না।

কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর সাহাবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.), আব্দুল্লাহ বিন ওমার (রা.), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.), আনাস বিন মালেক (রা.), আবু সাঈদ খুদরী (রা.), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.), সাহল বিন সায়াদ (রা.), যায়েদ বিন আরকাম (রা.), সালামাতা ইবনুল আওকা (রা.)-সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) ও তাঁর পরিবারবর্গকে অনেক বেশি ভালবাসতেন।

তাঁরা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার কারণে কোনো কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম, তাযিয়া মিছিল, আলোচনাসভা কোনোকিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সঠিক বোধ দান করুন। আমিন।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *