মে ২০, ২০২৪


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পরও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) পদত্যাগ ঠেকানো যাচ্ছে না। পর্ষদ সদস্যদের মতের সঙ্গে বনিবনা না হলেই এমডিদের চাপে রাখা হয়। এক পর্যায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। গত এক বছরের কিছু বেশী সময়ের মধ্যে অর্ধডজন এমডি পদত্যাগ করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো নীতিমালা দিয়ে চলছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। এটি আরও আধুনিয়ান করা উচিত। এই দুই যুগে ব্যাংকের আমানত ও ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সে অনুযায়ী নীতিমালার সুবন্দোস্ত হয়নি। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে সবগুলো সব নীতিমালা আধুনিকায়ন করা।

গত ২০২৩ এর জানুয়ারি থেকে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথার্ধ পর্যন্ত এনআরবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এসবিএসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের এমডির পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে শুধু এসবিএসি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডিকে ফেরানো গেলেও বাকীদের মধ্যে আর কাউকে ফেরানো যায়নি। যদিও এসবিএসি ব্যাংকের এমডির সঙ্গে বনিবনা হওয়ায়, পদত্যাগের ঘটনা অস্বীকার করা হয়। ওই এমডি এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।

পদত্যাগ করা এমডিদের মধ্যে সবারই পর্ষদের অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নেওয়ার চাপ ছিল বলে জানা গেছে। আরও স্পষ্ট করে বললে পর্ষদের পক্ষ থেকে অনৈতিকভাবে বিভিন্ন ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়, যেটি এমডিরা মেনে নেন না। এরপর সেই এমডির বিরুদ্ধে নানা ধরণের চাপ প্রয়োগ শুরু হয়।

যেহেতু এমডি নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। সেজন্য এমডিকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তারা নতুন এমডি নিয়োগ দিতে চায়। যাতে পর্ষদের ইচ্ছে মতো কাজ করাতে পারে।

সব এমডিরাই ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও খটকা লেগেছে। এজন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করা এমডিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈঠক করেছে। এসবিএসি ব্যাংকের হাবিবুর রহমান ও পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান ও ব্যাংক এশিয়া থেকে আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরীর এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডাকা হয়। এরপরও থেমে নেই এমডিদের পদত্যাগ।

জানা গেছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এনআরবি ব্যাংকের এমডি মামুন মাহমুদ শাহ পদত্যাগ করেছেন বলে ব্যাংকপাড়ায় খবর ছড়িয়ে পরে। পদত্যাগের খবরকে ঘিরে কয়েক দিন ধরে ব্যাংকিং খাতে কানাঘুষা চলছে। ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ব্যাংকের স্বার্থে নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় কিছু ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ নিয়েই কিছু ব্যাংকের এমডি চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন।

এনআরবি ব্যাংকের এমডি মামুন মাহমুদ শাহ পদত্যাগ করেছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তিনি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ২১ জানুয়ারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এমডি হিসেবে তার মেয়াদ ছিল ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার ১২ দিন আগেই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

এনআরবি ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাকির আমিন চৌধুরী বর্তমানে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মামুন মাহমুদ তাঁর পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত কারণে আমি আর এনআরবি ব্যাংকের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছি না। এজন্য ২১ জানুয়ারি থেকে আমার পদত্যাগপত্র দিয়েছি। পাশাপাশি অসুস্থতাজনিত কারণে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি চান তিনি। চুক্তি অনুযায়ী ওই দিনই তার শেষ কর্মদিবস হওয়ার কথা ছিল।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তিনি ‘ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যগত কারণ’ দেখিয়েছেন বলে জানা গেছে।

গত বছরের জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মাথায় ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী পদত্যাগ করেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে এসবিএসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান নিয়োগের আট মাসের মাথায় পদত্যাগ করেন। তাঁরও মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি এ পদে বহাল আছেন।
গত বছরের জানুয়ারিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেন। পরে যদিও তিনি দায়িত্বে ফিরেছেন। গত বছরের মার্চে ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) পদত্যাগ করেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নানা সময়ে ব্যাংকের পরিচালকদের দ্বারা ব্যাংকের এমডিরা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। অতীতে ন্যাশন্যাল ব্যাংকের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হওয়ায় নানা সময়ে ব্যাংকটি থেকে এমডিদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এনআরবি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অনৈকিভাবে নানা ঋণ দেওয়ার বিষয়ে এমডির উপর চাপ ছিল। যদিও ব্যাংকটির পক্ষ থেকে এটি অস্বীকার করা হয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার একটি সূত্র বলছে, একটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনকে কেন্দ্র করে এমডি পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরিচালনা পর্ষদ ওই ঋণ অনুমোদনে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করায় তিনি পদত্যাগ করেন।

পরিচালকদের চাপে ব্যাংক এমডিদের পদত্যাগ ঠেকাতে ২০১৪ সালে একটি সুরক্ষা নীতিমালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই নীতিমালা দৃশ্যত খুব একটা কাজে আসেনি। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় আসার সময় তৎকালীন এমডিদের বাদ দেয় পরিচালনা পর্ষদ। তখন নতুন এমডি হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করে অনুমোদনও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নীতিমালা যুগোপযুগী করা উচিত। পাশাপাশি জনবল বাড়ানো উচিত। ব্যাংকিং খাতের পরিধি অনেক দূর ছড়িয়েছে। কিন্তু সেভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অগ্রসর হতে পারেনি।

এনআরবি ব্যাংকের এমডি সম্পর্কে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, উনার কথাবার্তা অনেক ভাল মনে হয়েছে। উনি বলছেন ‘জীবনে ব্যাংকিং শিখেছি এই চাকুরি করেই চলতে হবে।’ এতে বিষয়টি স্পষ্ট যে পর্ষদের সঙ্গে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সুযোগ পেলে সে হয়তো অন্য কোনো ব্যাংকে চাকরী করবে। তার মানে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এমডিদের চাকুরী নিরাপত্তা বিধান করা।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *