হবিগঞ্জে ২০০৩, ২০১০ ও ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় চোখের সামনে তলিয়ে যায় হাওর এলাকার পাকা ধান। প্রতি ৭ বছর পর হওয়া এই বন্যার আশংকা রয়েছে এবারের মৌসুমেও। চৈত্র মাসের বৃষ্টি ও বিভিন্ন লক্ষণ থেকে এই আশংকা করছেন আবহাওয়াবিদরা। ফলে হাওর এলাকায় ফসল নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তবে যারা স্বল্প জীবন কালের ধানের জাত আবাদ করেছেন তাদের ঝুঁকিমুক্ত হয়ে ফসল ঘরে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
বুধবার বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামে গুঙ্গিয়া জুড়ী হাওর ঘুরে দেখা যায়, বোরো ধানের বিশাল ফসলের মাঠে সবুজের সমারোহ। চৈত্র মাসের বৃষ্টি পেয়ে ধানগাছ গুলো সজিবও সতেজ। তবে এখন ও ধান গাছে ফুল আসেনি। কিন্তু যারা ব্রি-৮৮সহ নতুনউদ্ভাবিত ফসল ফলিয়েছেন সেই জমি গুলোতে ধানের শীষ বের হয়েছে। একই হাওরে চোখের সামনে স্পষ্ট ব্যবধান দেখে কৃষকদের মাঝেও আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হাওরে কথা হয় হবিগঞ্জসদরউপজেলার কৃষক খেলুমিয়ার সাথে। তিনি বলেন, এনজিও এসেড এর পরামর্শে ব্রি-৮৮ ধানের আবাদ করেছেন জমিতে। অন্য কৃষকদের জমিতে এখনও ধানের শীষ আসার কোন লক্ষন নেই। কিন্তু তার জমিতে ধানের শীষ এসেছে। চৈত্র মাসের মাঝেই ফসল ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
একই গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক লালমিয়া বলেন, তার জমিতে সনাতন জাতের ধান আবাদ করেছেন। এখনও শীষ আসার কোন খবর নেই। যদি জানতেন ব্রি-৮৮সহ আগাম জাতের কথা, তাহলে বীজ সংগ্রহ করে এই ফসলই আবাদ করতেন। কৃষকরা যাতে সহজেই এই ধানবীজ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করার দাবী জানান তিনি।
হবিগঞ্জের হাওর এলাকায় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধানেরই আবাদ হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে ওই ধান আবাদ করে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর বিকল্প জাতের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকদের মাঝে এই পরিবর্তন আনতে কাজ করছে হবিগঞ্জের এনজিও এসেড। হবিগঞ্জের হাওর এলাকার কৃষকদের আগাম বন্যা থেকে ফসল সুরক্ষার জন্য জাপানী অর্থায়নে ৫ বছরের জন্য তারা নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে। জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকার আর্থিক ও বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট এর কারিগরি সহায়তা নিয়ে ‘প্র্যাকটিস এন্ড ডিস্যামিনেশন অব ডিজাস্টার রেসিস্ট্যান্ট ক্লাইমেট চেঞ্চ এ্যাডাপটিভ এগ্রিকালচার ইন হাওর এরিয়া ’শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা সুফল পেতে শুরু করেছেন।
এই প্রকল্পের আওতায় এ বছর হবিগঞ্জ সদর উপজেলার তেঘরিয়া ও লস্করপুর ইউনিয়নে ১০০ জন করে মোট ২০০ জন এবং বানিয়াচং উপজেলার পুকড়াই উনিয়নে ২০০ জনসহ মোট ৪০০ জন কৃষকের মাঝে স্বল্প জীবন কালের উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি ৬৭, ব্রি ৮৪, ব্রি ৮৮ এবং ব্রিহাইব্রিড ৫ ধান বীজ সরবরাহ করা হয়।
এই বীজে ২হাজার ২শ একর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এতে ফলন হবে ৪৪ হাজার মন। এছাড়াও হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় ৩ হাজার কেজি স্বল্প জীবনকালের উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের বীজ বিতরণ করা হয়।
এসেড এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাফর ইকবাল চৌধুরী জানান, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ও বানিয়াচং উপজেলার পুকড়া ইউনিয়নে জাপানী সহায়তায় ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল জলবায়ূর ক্ষতিকর প্রভাব মোকবেলায় সক্ষম কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে আগাম বন্যা থেকে কৃষকদের সুরক্ষা প্রদান।
বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সমন্বয় সৃষ্টি ও ব্রির উদ্ভাবিত নতুন জাত সহজেই কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়ে ৩১ মার্চের পূর্বেই কিভাবে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলতে পারে এবং উৎপাদন বেশী হয়, এটিই এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য। এই প্রকল্পের ইতিবাচক দিকগুলো হাওরে স্পষ্ট হওয়ায় কৃষকদের মাঝে নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছে। তবে কৃষকরা যাতে স্বল্প মেয়াদের এই ধান জাতের বীজ সহজেই পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার।
জাপানী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ টেটসুয়োসুটসুই বলেন, হবিগঞ্জে এর আগেও এসেড এর সাথে ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সফলতাঅর্জন হওয়ায় এবার ৫ বছরের প্রকল্পে তারা সহায়তা দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এই এলাকার হাওর বাসীর উন্নয়নে জাপানী সরকারের আরও বেশী সহায়তা আসবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট হবিগঞ্জ এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মামুনুর রশিদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রচলিত ধানের অনেক জাত আজ বিলুপ্তির পথে। তবে আশার কথা হচ্ছে সময়ের পরিবর্তনের সাথে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। কৃষকদেরকে নতুন জাতের ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরে আলম জানান, এ বছর হবিগঞ্জ জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৩১৫ হেক্টর। কিন্তু আবাদ হয়েছে বেশি। ১ লাখ ২২ হাজার ৮১২ হেক্টর। এ বছর কৃষকরা ব্রি-২৮ ও ২৯ অল্প পরিমাণে আবাদ করেছে। কৃষকদের মাঝে ব্রি ৮৮, ব্রি ৮৯, ব্রি ৯২, ব্রি ৯৬, বঙ্গবন্ধু ১০০ ও বিনা ২৫ জাতের ধান আবাদে ঝুকছেন। চৈতালী ও বৈশাখী ঢল থেকে ফসল সুরক্ষায় কৃষকরা যাতে বেশি করে স্বল্প মেয়াদ কালের জাত আবাদ করে তার জন্য পরামর্শ ও কারিগরী সহায়তা দিচ্ছে কৃষিবিভাগ। খবর বাসস।