সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে সরকার। এরপরেও সাধারণ মানুষ এখন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ সবচাইতে নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছেন। বর্তমানে চার ধরণের সঞ্চয়পত্র প্রচলিত আছে। এগুলো হচ্ছে- পেনশনার সঞ্চয়পত্র, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র (তিন বছর মেয়াদি)।
বর্তমানে অর্থনীতিতে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় করে তুলেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট আয়ের একজন মানুষের জন্য বিনিয়োগের জায়গা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। সঞ্চয়পত্র অথবা ব্যাংকে যে ধরণের বিনিয়োগ জনপ্রিয় ছিল তাতে সুদের হার কমিয়ে দেয়ার কারণে সেগুলো আর ততটা লাভজনক নেই। এরফলে এসব যায়গায় বিনিয়োগ করতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
জানা যায়, ৫০ হাজার টাকা, ১ লাখ টাকা, ২ লাখ টাকা, ৫ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পেনশনার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পরিবার সঞ্চয়পত্র রয়েছে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের।
বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। এছাড়া যাদের সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্র কোথা থেকে কেনা ও ভাঙানো যায়-
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়, সব তফসিলি ব্যাংক ও সব ডাকঘর থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। একই জায়গা থেকে ভাঙানোও যায়। ভাঙানোর দিন গ্রাহককে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আবেদন করার নিয়ম রয়েছে।
কোন কোন ব্যাংক থেকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে-
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড, এবি ব্যাংক লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, যমুনা ব্যাংক লিমিটেড, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড, পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড, মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড, মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড, মেঘনা ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, সীমান্ত ব্যাংক লিমিটেড, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসি, সিটিব্যাংক এনএ, এইচএসবিসি, উরি ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, হাবিব ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ভারতীয় স্টেট ব্যাংক, ব্যাংক আলফালাহ্, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে যা করবেন-
১. সব সঞ্চয়পত্রেরই নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে। ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করেই এ ফরম পাবেন। সঞ্চয়পত্র কিনতে ফরম পূরণ করতে হবে এবং সঙ্গে দিতে হয় গ্রাহক ও নমিনির দুই কপি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি। গ্রাহকের ছবি সত্যায়িত করতে হয় প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর মাধ্যমে। তবে নমিনির ছবির সত্যায়িত করতে হবে গ্রাহককে।
২. পাঁচ লাখ টাকার বেশি অঙ্কের সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ই-টিআইএন) থাকতেই হবে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত অবশ্য ই-টিআইএন লাগে না।
৩. গ্রাহক ও নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি অবশ্যই দিতে হবে। নমিনি নাবালক হলে জন্মনিবন্ধনের কপি লাগবে।
৪. গ্রাহকের নিজ ব্যাংক হিসাবের চেকের কপি, যে হিসাবে গ্রাহকের মুনাফা ও আসল টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে, সে হিসাবের নম্বর লাগবে। পেনশনের সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি কাগজ হিসেবে লাগবে সর্বশেষ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সনদ।
৫. পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনের সঞ্চয়পত্র।
এদিকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রজ্ঞাপন জারি করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়েছে সরকার। একই প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি স্তর করে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। এর পর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হচ্ছে।
বিনিয়োগ কমার আরও কারণ রয়েছে। যেমন পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক গ্রাহককে বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক হিসাবে পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ব্যাংক হিসাবে জমা টাকা ১০ লাখ অতিক্রম করলেও দিতে হয় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র।
গেল অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে (জুলাই-মে) ৭৪ হাজার ৭১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এগারো মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কোনো ঋণ পায়নি। উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের চাপে মূল ও মুনাফাসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এক সময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন বেশিরভাগ গ্রাহক। তবে এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে এখানে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যে কারণে বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বেশি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা বা ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিলো ৩৫ হাজার কোটি টাকা।