কৌতুক যত ঝটপট বলে ফেলা যায়, হাসির বেগ তত বাড়ে। ব্যাখ্যা করতে গেলে কৌতুক আর হাস্যকর থাকে না। কিন্তু ভারতের এক কৌতুক অভিনেতাকে বারবার নিজের কৌতুক ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। জনে জনে, এমনকি আদালতে গিয়েও তাকে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে।
এ কৌতুক অভিনেতা আর কেউ নন, সম্প্রতি ভারতের রিয়েলিটি শো বিগ বস বিজয়ী মুনাওয়ার ফারুকি।
‘মানুষ সাধারণত কৌতুক বলার পর ক্ষমা চায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা, কৌতুক বলার আগেই ক্ষমা চাইতে হয়,’ বিগ বসের এক পর্বে এ কথা বলে দর্শক হাসান ফারুকি। চটুল এ কথাটির পেছনে রয়েছে গুরুতর পটভূমি।
গুজরাটের এক নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবার থেকে উঠে এসে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছিলেন ফারুকি। হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলিম হিসেবে বিভিন্ন দাঙ্গার সময় তার অভিজ্ঞতা, মুসলিমদের নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, সংখ্যালঘু হিসেবে তার জীবন – এসব নিয়ে সাহসী রসিকতা করে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
ইন্দোর শহরে এক অনুষ্ঠান ছিলো ফারুকির। এরপর ভারতের ১৪টি শহরে তার একটি ট্যুর করার কথা ছিল। কিন্তু ওই শহরেরই এক চরমপন্থী হিন্দু সংগঠন তাতে বাধ সাধে। ওই সংগঠন দাবি করে, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে রসিকতা করেছেন ফারুকি, ফলে এই কৌতুক অভিনেতাসহ আরও চারজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা হলফ করে বলেন, ওই অনুষ্ঠানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো কিছু বলেননি ফারুকি, এমনকি তার রসিকতা শুরুর আগেই তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশও স্বীকার করে, যে ফারুকি আপত্তিকর কিছু বলেছেন, এমন প্রমাণ নেই তাদের কাছে।
যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেলো। প্রমাণ ছাড়াই জেলে ৩৫ দিন কাটান ফারুকি। জেল থেকে তিনি ছাড়া পাওয়ার পরেও হিন্দু সংগঠনগুলো তার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি কৌতুক অভিনয় ছেড়ে দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
‘ঘৃণার জয় হয়েছে। শিল্পী হেরে গেছে। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি,’ ফারুকি এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লেখেন।
ফারুকির গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। মাস দুয়েক পরই একটি ব্যতিক্রমী রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ‘লক আপ’ নামের ওই শো-তে অংশগ্রহণ করেন ফারুকির মতো মোট ১৬ জন ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তি। তারা ৭২ দিন নকল একটি জেলে সময় কাটান। পর্বে পর্বে ফারুকির ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য সামনে আসে। তবে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে যান তিনি।
৭০ পর্ব শেষে বিজয়ী হিসেবে বের হয়ে আসেন ফারুকি। এই শোয়ের মাধ্যমে নিজের পাবলিক ইমেজ পাল্টে ফেলেন তিনি , তার ক্যারিয়ারেও নতুন গতি সঞ্চার হয়। স্পটিফাই এবং ইউটিউবে তার র্যাপ গানের ক্যারিয়ার জমে ওঠে। ধীরে ধীরে কৌতুক অভিনয়েও ফিরে আসেন তিনি। নতুন করে বাড়তে থাকে তার ফ্যানের সংখ্যা।
‘তার জীবনের গল্পে মিশে গেছে সংগ্রাম,’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অসিম আলি বিবিসিকে বলেন। ‘তিনি জেল খেটে বের হয়েছেন, সংবাদ মাধ্যমের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, কিন্তু এরপরেও ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।’
জেল খাটার ঠিক তিন বছর পর বিগ বস রিয়েলিটি শো জেতেন ফারুকি। বিজয়ী হিসেবে তিনি পাবেন পাঁচ মিলিয়ন রুপী বা ষাট হাজার মার্কিন ডলারের কিছু বেশি অর্থ।
ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুদের রোষানলে পড়া মুনাওয়ার কী করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিজেকে নিয়ে গেলেন, সেটা অবশ্য তার শৈশব থেকেই দেখা যায়। গুজরাটের ‘দংরি’ নামের এক মুসলিম বস্তি এলাকা থেকে উঠে এসে তিনি নিজেকে একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে। অপরাধপ্রবণতার জন্য কুখ্যাত ওই এলাকাটি, এমনকি মুম্বাইয়ের এককালের ত্রাস দাউদ ইব্রাহিমের উত্থানও সেখানেই।
মুনাওয়ারের বিগ বস জয় করাটা দংরির মানুষের জন্যেও প্রেরণাদায়ক, আলি বলেন। ‘বাধা পেরিয়েও তরুণ মুসলিমরা কী করে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তারই উদাহরণ ফারুকি।’