ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

ঋণ অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক দুরবস্থা ও ‘অস্তিত্বের সংকটে’ পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৭টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। নানা সময়ে এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলো বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ও এস আলমসহ কয়েকটি গ্রুপ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে চরম খারাপ অবস্থায়। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ।

দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে প্রশান্ত কুমার হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার পরে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিগত সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে আবারও পুনরুজ্জীবিত করা হয় এসব প্রতিষ্ঠান।

সূত্র মতে, জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। পি কে হালদারসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠানটির সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠাটির ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটি মোট বিতরণ করেছে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। একই সমযে প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি ৫৫০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি আমানতকারী ও ফাইন্যান্স কোম্পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাসহ জনস্বার্থে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা যায়, ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপ। সেই সময় পর্যন্ত এফএএস ফাইন্যান্সের প্রায় ৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির হাতে।

তখন সেটি ভালো মানের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে এফএএস ফাইন্যান্সের পর্ষদে যুক্ত হতে শুরু করেন পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল ও রেপটাইল ফার্ম নামে দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। আর নিটল-নিলয় গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটি ছাড়তে শুরু করে। এরপর আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি পি কে হালদারের সমর্থনে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় যুক্ত হয় সিমটেক্স ও ডিজাইন অ্যান্ড সোর্স নামের আরো দুটি প্রতিষ্ঠান। এরই একপর্যায়ে ২০১৭ সালে পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলে যায় পি কে হালদারের হাতে। এরপর থেকেই অর্থ লুটপাট চলে প্রতিষ্ঠানটিতে।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট আলোচিত প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। এই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা।

তালিকার তৃতীয় অবস্থানে পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ৮৯১ কোটি টাকার মধ্যে ৯৭ দশমিক ৯৬ শতাংশই খেলাপি। প্রভিশন ঘাটতি না হলেও খেলাপিসহ অন্যান্য কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ১৩১ কোটি টাকার লভ্যাংশ নিজ হিসাবে যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি) বর্তমানে খেলাপির দিক দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতিও রয়েছে আড়াই কোটি টাকার বেশি।

তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং লুটে নেতৃত্ব দিয়েছেন আলোচিত পি কে হালদার। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন পথে বসেছে। আলোচিত পি কে হালদারের নেতৃত্বে টাকাগুলো লুট করা হয়।

আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল আছে তালিকার ষষ্ঠ অবস্থানে। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

দুর্বলতায় ডুবতে বসা ফার্স্ট ফাইন্যান্সর তালিকায় রয়েছে সপ্তম স্থানে। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৮ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৮৩ কোটি টাকার বেশি।

এদিকে আলোচিত এই সাত কোম্পানির মধ্যে শুধু বিআইএফসির শেয়ার দর ফেসভ্যালুর কিছুটা উপরে অবস্থান করছে। বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর দীর্ঘদিন ধরে ফেসভ্যালুর অনেক নিচে পড়ে রয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলোচিত প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার দর সবচেয়ে কম। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার ৩ টাকায় নেমেছে। এরপর ফাস ফাইন্যান্সের শেয়ার দর ৩ টাকা ৬০ পয়সায় অবস্থান করছে। গত এক বছর ধরে ফাইন্যান্স কোম্পানি দুটির শেয়ার দর ধারাবাহিকভাবে কমছে।

তথ্য আরও বলছে, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার দর ৪ টাকা ৩০ পয়সায় নেমেছে। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড বা বিআইএফসির শেয়ার দর ১০ টাকা ৩০ পয়সায় অবস্থান করছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার দর ৪ টাকা ৩০ পয়সা, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের শেয়ার দর ৭ টাকা ২০ পয়সা এবং ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার দর ৪ টাকা ১০ পয়সায় অবস্থান করছে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...