বাংলাদেশে ‘প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি’ বলতে কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত সপ্তাহে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনদের দমনপীড়নের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।’
রাজধানী ঢাকায় নিজের অফিসে বসে গত সপ্তাহে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ মঙ্গলবার ইউনূসের সেই সাক্ষাৎকার এবং তার বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রয়টার্স।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই মন্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘শুধু আমিই তাঁর সঙ্গে একমত নই এমন নয়, দেশের মানুষও তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবে। এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি দেশের মানুষকে অপমান করলেন। দেশে গণতন্ত্র পুরোপুরিভাবেই রয়েছে।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে জয়ের মাধ্যমে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তবে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এই নির্বাচন বয়কট করে। তাদের অনেক নেতা জেলে বন্দী। আর অনেক নেতা দেশেই থাকতে পারছেন না।
২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনার কারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. ইউনূস দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এমনটাই বলা হচ্ছে রয়টার্সের প্রতিবেদনে। তাঁর বিরুদ্ধে এখন মামলাও চলছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি ওই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূসের অভিযোগ করেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যাপক দুর্নীতি করছে। কার্যত কোনো বিরোধী দল এখানে নেই।
ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতি বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মাত্র একটি দল রয়েছে এখানে। আর এই দলটিই সব দখল করে আছে। তারাই সব করছে। আর এভাবেই ওরা নির্বাচনে জিতেছে। বিভিন্ন উপায়ে তারা তাদের লোকদের জিতিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রার্থী বানানো, ডামি প্রার্থী দাঁড় করানো এবং স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত করা। আর এসব প্রার্থীর সবাই একই দলের।’
রয়টার্স বলছে, ক্ষুদ্রঋণের কারণে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পান ড. ইউনূস। ২০১১ সালে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয় শেখ হাসিনা সরকার। কারণ হিসেবে বলা হয়, অবসরের বয়স ৬০ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি এই পদে রয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা এই নেত্রী দেশটির অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তবে, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভিন্নমত দমনের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি। প্রায় একই কথা বলেছে যুক্তরাজ্যও। বাংলাদেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এটি লজ্জার নির্বাচন। এ নির্বাচন বাতিল ও শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দেয় দলটি।
নির্বাচনের ঠিক আগেই শ্রমআইন ভঙ্গের দায়ে ড. ইউনূসকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও তিনি জামিনে বাইরে আছেন। এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন ড. ইউনূস। তবে, তাঁর বিরুদ্ধে এমন আরও শতাধিক মামলা রয়েছে। এসব ‘বানোয়াট’ বলেই দাবি তাঁর।
এসব দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও গেছেন, যেখানে গিয়ে দেখেন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।’
এ সময় ড. ইউনূসের কর পরিশোধের ঘটনাটি উদাহরণ হিসেবে বলেন আনিসুল হক। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেও শুনানি হয়েছে। বাকি মামলা নিয়ে আনিসুল হক কোনো মন্তব্য করেননি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, নাগরিক শক্তি নামের একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেছিলেন ড. ইউনূস। তাঁর সমর্থকেরা বলছেন, এ কারণেই তিনি শেখ হাসিনা সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন। তবে শেখ হাসিনা এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইউনূস রক্তচোষা’।
ওই সময় ঘোষণা দেওয়ার কিছুদিন পরই দল গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন বলে জানান ড. ইউনূস। কারণ হিসেবে তিনি জানান, রাজনীতিতে নিজেকে উপযুক্ত মনে করেননি। এ নিয়ে এই নোবেলজয়ী বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা কি একজন নাগরিকের অপরাধ?’
বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির মাঠ প্রস্তুত করা এখন বেশ কঠিন উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন করে শুরু করা এখন বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ আমরা এটাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি, যেখানে এটা (প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি) পুরোপুরি অদৃশ্য।’