নভেম্বর ১৪, ২০২৪

পাকিস্তানে জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শাহবাজ শরিফ। এর আগেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিন মেয়াদে ১৩ বছর ধরে প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মি. শরিফ। ওই সময়ে অনেকবারই আবেগপ্রবণ আচরণ ও ভিন্নধারার কাজের কারণে তিনি মিডিয়া ও বিরোধীদের আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। তিনি কিভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন? মুখ্যমন্ত্রী থেকে কী করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছলেন?

নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ পিএমএল-এন ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি মিলে নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

২০২২ সালে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিরোধীদলীয় নেতা থেকে সংসদ নেতা হয়েছেন মি. শরিফ। ওই সময়ও তাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে একজন নবাগত হিসেবে বিবেচনা করতেন অনেকে। পাঞ্জাব প্রদেশের স্থানীয় রাজনীতির একজন নেতা হিসেবেই তার পরিচয় বেশি উজ্জ্বল ছিল।

কখনো তাকে দেখা গেছে নৌকায় চড়ে বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে যেতে। কখনো বা তার সরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানেই চালিয়েছে ‘আকস্মিক অভিযান’। এসব ঘটনায় বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হতো-‘এসবই লোক দেখানো কাজ, নইলে মিডিয়া কেন তার সঙ্গে থাকবে’?

যাই হোক, সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের যারা তাকে চেনেন, তারা মনে করেন তিনি একজন ‘পরিশ্রমী নেতা’। পাঞ্জাবে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছেন তিনি।

পারিবারিক ব্যবসা থেকে রাজনীতির হাল ধরেন যেভাবে

লেখাপড়া শেষে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ।

লাহোরের একজন সিনিয়র সাংবাদিক সালমান গনি বহুদিন ধরে শরিফ পরিবার ও তাদের দল নিয়ে রিপোর্টিং করছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ১৯৮৫ সালে লাহোর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট হন শাহবাজ শরিফ। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে জিতে তিনি প্রথমবারের মতো পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির একজন সদস্য হন। ১৯৯০-৯৩ সালেও তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালেই প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন মি. শরিফ।

পরের সাধারণ নির্বাচনে পিএমএল-এন জেতার পর ১৯৯৭ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। ওই সময়ের রাজনীতির সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল একজন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মুজিব-উর-রহমান শামি। বিবিসিকে তিনি বলেন, তিনি (শাহবাজ শরিফ) পাঞ্জাবে একটি ভাল টিম গঠন করেছিলেন।

মি. শরিফ বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন পাঞ্জাবে, কিন্তু তার সরকারের অকাল-পতন ঘটে যখন ১৯৯৯ সালে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফকে গ্রেফতার করেন।

২০০০ সালে শরিফ পরিবার সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফের সাথে এক চুক্তি করার অভিযোগে ফেঁসে যায়। এর ফলে একপর্যায়ে শাহবাজ শরিফ দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। শরিফ পরিবার অবশ্য বরাবরই এ চুক্তির অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

নওয়াজের শূন্যস্থান পূরণ

রাজনীতিতে সবসময়ই বড় ভাই নওয়াজ শরিফের ছায়াতলে দ্বিতীয়সারির ভূমিকায় থেকেছেন শাহবাজ শরিফ। বড় ভাই যখনই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তখনই শাহবাজ শরিফ হন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী।

মুজিব-উর-রহমান শামির বর্ণনায়, শাহবাজ শরিফ গণমানুষের নেতা ছিলেন না, বরং তিনি একজন ভাল প্রশাসক ছিলেন। যিনি সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বে জড়ানোর পক্ষপাতী নন। যাই হোক, পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৭ সালে, যখন পানামা পেপার্স ফাঁসের জেরে সুপ্রিমকোর্ট নওয়াজ শরিফকে আজীবনের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য ঘোষণা করে।

এরপর শাহবাজ শরিফ দলীয় প্রধানের পদ পান ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হন শহিদ খাকান আব্বাসি। ওদিকে কিছুদিন জেল খাটার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে যান নওয়াজ শরিফ।

এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাব থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রের রাজনীতিতে যোগ দিতে মনস্থ করেন শাহবাজ শরিফ। তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলের প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের নেতা হন। ২০২২ সালের এপ্রিলে কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার পর পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে যান ইমরান খান।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন-চার দফা মূলতুবি হওয়ার পর মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

মি. শরিফ প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তার প্রার্থিতা জমা দেন। অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টির বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারিও তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। সেই দফায় প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন শাহবাজ শরিফ।

চীনের সাথে সৌহার্দ্য

২০১৩ সালের ভোটে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। তিনি চীনের সাহায্যে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর প্রকল্পে হাত দেন।

উন্নয়ন প্রচেষ্টা

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের কিছু প্রকল্প নিয়েও কাজ করেছেন শাহবাজ শরিফ, কিন্তু তার সময়ের দুটো বড় প্রকল্প নিয়ে মারাত্মক সমালোচনা হয়েছিল। তার একটি মেট্রোবাস প্রকল্প। লাহোরে যানজট কমাতে মেট্রো বাস চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। এর সমালোচনা করেন ইমরান খানসহ বিরোধী রাজনীতিকরা। কিন্তু প্রকল্পটি সফল হয়। এরপর মুলতান, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদেও একই রকম প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি ইমরান খানের প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়াতেও এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। অন্য প্রকল্পটি অরেঞ্জ লাইন। পাকিস্তানের প্রথম মেট্রোরেল সেবাও চালু হয় তার হাত ধরে এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...