জ্বালানি সংকটে ধুকতে থাকা বস্ত্রখাতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে এ খাত বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কায় পড়বে বলে মনে করছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকদের এ সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলছেন, গ্যাস সংকটে এখন যান্ত্রিক সক্ষমতার অর্ধেক অচল হয়ে রয়েছে। এ সংকটের সমাধান কিংবা বিকল্প সহায়তা চালু করার আগে এ ধরনের উদ্যোগ মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।
আজ রোববার ঢাকার কারওয়ানবাজারে সংগঠনের দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এর ফলে এ শিল্প মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে এবং এ শিল্পের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে। ব্যাপক সম্ভাবনাময় শিল্পটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাট শিল্পের মত বিলুপ্ত হতে পারে।
”নভেম্বর ২০২৬ এর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কথা বলে নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে। কিন্তু এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের এখনো প্রায় আড়াই বছর বাকি এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলেও গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শিল্পখাতগুলো নগদ প্রনোদনা পেতে পারে।“
তার ভাষ্য, “আমাদের পাশের দেশ ভারত ২০০৪ সালে এলডিসি হতে গ্র্যাজুয়েট হলেও এখনও তাদের টেক্সটাইল সেক্টরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগদ সহায়তার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে আসছে। অথচ ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ এবং টেক্সটাইল টেকনোলজিতেও বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে।”
তার অভিযোগ, “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের নামে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা ব্যাপকভাবে কমিয়ে এ শিল্পে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে এ শিল্প অচিরেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যাবে।”
রপ্তানিমুখী পোশাক খাত রপ্তানির বিপরীতে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা পেয়ে আসছিল। তবে ২০২৬ সালের নভেম্বরে নিম্ন আয়ের মর্যাদা থেকে উন্নীত হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে প্রণোদনা কমাতে শুরু করেছে সরকার। কারণ, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে এ ধরনের সহায়তা আর দেওয়া যবে না।
গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্রে পোশাক খাতসহ ৪৩টি রপ্তানি পণ্যের বিপরীতি ঘোষিত প্রণোদনার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। সেখানে রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্রখাতে শুল্ক, বন্ড ও ডিউটি ড্র ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়।
ইউরোপীয় অঞ্চলে বস্ত্রখাতের রপ্তানিকারকদের জন্য বিদ্যমান দেড় শতাংশের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা ১ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের অন্তর্ভুক্ত সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অতিরিক্ত সুবিধা ৪ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশ করা হয়। তৈরি পোশাক খাতের বিশেষ নগদ সহায়তা দশমিক ৫ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়।
নতুন এ প্রণোদনা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে সংবাদ সম্মেলনে এসে নিজেদের শঙ্কার কথা তুলে ধরলেন বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীদের নেতারা।
বিটিএমএ এর সভাপতি ভারতের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ভারতে পোশাক ও বস্ত্র খাতে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা এবং উপখাতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে। নতুন শিল্প নির্মাণে প্রকল্প ব্যয়ের ৪০ শতাংশ বা ৪০ কোটি রুপি সরকার অর্থায়ন করছে। অন্ধ্র প্রদেশে সবুজ কারখানায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূলধন সহায়তা দেওয়া হয়। গুজরাটে টেক্সটাইল পার্কে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মূলধনী ব্যয়ে অর্থায়ন করে সরকার। বিহারে শিল্প স্থাপনের প্রথম ৫ বছরে ২ রুপিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত খরচ ধরা হয়।
তিনি বলেন, বিগত ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্বালানি সংকটের কারণে বস্ত্র খাত স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বিগত কয়েক মাস যাবত তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে মিলগুলো উৎপাদন ক্ষমতার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়য় উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, যা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এ খাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করছে।
বর্তমানে দেশে বিটিএমএ সদস্যভুক্ত ৫১৯টি স্পিনিং মিল, ৯৩০টি উইভিং মিল ও ৩২২টি ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল রয়েছে। গত চার দশকে এ খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশ টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল খাত থেকে অর্জিত হয়েছে যাতে বিটিএমএ সদস্যরা প্রায় ৭০ শতাংশের যোগানদাতা। বর্তমানে বিটিএমএ’র সদস্য মিলগুলো তৈরি পোশাক শিল্পের মধ্যে নিট খাতের প্রয়োজনীয় সুতার প্রায় ৯০ শতাংশ এবং উইভিংয়ের ৪৫ শতাংশ সরবরাহ করছে।
বিটিএমএ এর সদস্য মিলগুলো ডেনিম, হোম টেক্সটাইল ও টেরি টাওয়ালের শতভাগ দেশি চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি আয়ে ব্যাপক অবদান রাখছে।