

পাকিস্তানে নির্বাচনের ফল পেছানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের দিন ও পরের রাতে সারা দেশে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয় এবং ২৪ ঘণ্টা পরও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।
গত দুদিনের ঘটনাবলি দৃশ্যত বিদ্যমান বিভাজন এবং রাজনৈতিক ফাটলকে আরও গভীর করেছে।
পরবর্তী সরকার কে হবেন তা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারীকে একদিকে নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করতে দেখা গেছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকেও এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
তবে এই বিভাজন, বিভ্রান্তি ও জনরোষের ফল কী হবে, এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে গত চব্বিশ ঘণ্টার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত কী হয়েছে?
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টার পর কিছু ভোটকেন্দ্রে গণনা সম্পন্ন হলে সেখান থেকে অসমাপ্ত ও অনানুষ্ঠানিক ফলাফল আসতে শুরু করে।
এই প্রাথমিক ফলাফল সবাইকে অবাক করে, কারণ প্রত্যাশার বিপরীতে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এগিয়ে ছিল। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল আসা বন্ধ হয়ে যায়।
এ নিয়ে সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে ছিল বিতর্ক, যাতে ছিল নানা প্রশ্ন ও সংশয়।
মানুষের চোখ ছিল পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের দিকে, কিন্তু তাদেরও অসহায় দেখাচ্ছিল। রাত ১২টাতেও মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়নি এবং ভোট গণনার ফলাফলও বের হচ্ছিল না।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রার্থী ও সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করেন এবং ফলাফল বিলম্বকে ‘কারচুপির চেষ্টা’ বলে অভিহিত করেন।
রাতে এক পর্যায়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে ফল আসতে শুরু করার কথা বলা হলেও রাত ৩টা পর্যন্তও নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত কিছু আসেনি। সকালে আবার একই ঘোষণা দেওয়া হয় এবং বলা হয় ১০টার মধ্যে ফলাফল দেওয়া হবে, কিন্তু তাও করা হয়নি।
অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতিকে অভিনন্দন জানাতে দেখা গেছে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ভোটের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকবে না। তবে ভোটগ্রহণ শুরুর মাত্র ১০ মিনিট আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদের হুমকির আশঙ্কায় দেশজুড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়।
মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় ফল সংগ্রহের জন্য তৈরি করা নতুন ব্যবস্থায় কাজ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এই বিবৃতির আগে নির্বাচন কমিশনেই ঘোষণা করেছিল যে ইন্টারনেট ছাড়াও নতুন ব্যবস্থা সক্রিয় থাকবে।
অন্যদিকে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ক্যাম্পাসে ছিল সম্পূর্ণ নীরবতা। তবে মধ্যরাতে প্রকাশিত অনানুষ্ঠানিক ও অসমাপ্ত ফলাফলেও দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ নিজেও পিটিআইয়ের আটক ইয়াসমিন রশিদের চেয়ে বিশাল ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন।।
ইসলামাবাদ থেকে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থী শোয়েব শাহিন বলেন, বিচার বিভাগ, যারা যে কোনো ঘটনার বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে নজর দিতে পারে, তারা মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের বিষয়টি খেয়াল করেনি, গত রাতে ঘটে যাওয়া (কথিত কারচুপি) বিষয়টিও তারা খেয়াল করেনি এবং কেন ফলাফল এত দেরিতে আসছে সেটাও খেয়াল করেনি।
ইসলামাবাদে গতকাল রাত পর্যন্ত তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন বলে দাবি করলেও সকালে তিনি পরাজিত হন। তিনি বলেন, এখানে যারা সবচেয়ে শক্তিশালী তারা অন্য কাউকে জেতাতে চায়। তার মতো আরও অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করছেন।
শোয়েব শাহীন এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ উপস্থাপন না করায় নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা অভিযোগের জবাব দেওয়ার পরিবর্তে ফলাফল সংকলনে ব্যস্ত।
গত দুদিনের এসব ঘটনার পর ইতোমধ্যেই বিদ্যমান বিভাজন ও রাজনৈতিক ফাটল আরও গভীর হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আসমা শিরাজী বলছেন, অতীতের ভুল থেকে এবারও রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো শিক্ষা নেয়নি।
তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম এখনই সবকিছু ঠিক হবে, আমরা অতীতের ভুল থেকে শিখব। এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ছিল, মানুষ সিস্টেমে বিশ্বাস করে ভোট দিতে এসেছিল। এটাই গণতন্ত্রের সফলতা। কিন্তু যখন আপনি হঠাৎ করে ফলাফল বন্ধ করে দেন এবং ফলাফল পরিবর্তন হতে শুরু করে, তখন… পাঞ্জাবের ফলাফল আসতে আসতে থেমে গেল এবং তারপর পরিস্থিতি বদলে গেল।
তিনি বলেন, এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে ‘জনমত পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে এমন শক্তি কারা’। আর এটা একবার বা দুবার নয়, পঁচাত্তর বছর ধরে হয়ে আসছে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টার থিংক ট্যাংকের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আমি মনে করি এই আশঙ্কার কারণ খুবই পরিষ্কার যে কেন সামরিক বাহিনী তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য শেষ মুহূর্তে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে এবং সেই স্বার্থ হচ্ছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে সরাসরি ক্ষমতায় আসা থেকে বিরত রাখা।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন যে নির্বাচনের ফলাফলের সময়, পিটিআইয়ের সাফল্যের প্রাথমিক লক্ষণ এবং তারপরে দীর্ঘ সময় ধরে ফলাফল ঘোষণা, নির্বাচন কমিশনের সম্পূর্ণ নীরবতা এবং তারপরে আনুষ্ঠানিক ফলাফল যেখানে সামরিক পছন্দের দলটি একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করছে বলে মনে হচ্ছে, সবই শেষ মুহূর্তের কারচুপির পূর্বাভাস দেয়।
তিনি বিশ্বাস করেন যে পাকিস্তান এমন একটি ফলাফলের দিকে যাচ্ছে যা জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে না। এটি পাকিস্তানের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি আঘাত হবে।
এই নির্বাচনের পর দেশে স্থিতিশীলতা আসবে তো?
এই মুহূর্তে, এটি কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে কারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো এখনও বিভক্ত বলেই প্রতীয়মান।
আসমা শিরাজির মতে, স্থিতিশীলতা আসা উচিত। সবাইকে বসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাঞ্জাবে একটি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তবে এটিও সত্য যে একটি পক্ষ জিতছে। তবে এখন আমাদের সংলাপে যাওয়া উচিত। যদি তা না হয়, তাহলে এটি চলতে থাকবে এবং আমরা সেভাবেই চলতে থাকব। এখন ইমরান খানেরও কথা বলা উচিত… জনগণ যদি ফলাফল মেনে না নেয় এবং রাস্তায় নামে…
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, স্থিতিশীলতা ফেরা কঠিন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি না এই নির্বাচন পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা আনবে। তারা ইতিমধ্যে মেরুকৃত দেশকে আরও বিভক্ত করবে। পাকিস্তান শুধু চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখিই নয়, সন্ত্রাসবাদও আবার বাড়ছে।
বিশ্ব কীভাবে একটি অস্থিতিশীল পাকিস্তানকে দেখবে এবং বিশ্বশক্তির কাছে এর অর্থ কী তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এটি লক্ষ করা উচিত যে পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং এটি এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যা আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে, সম্প্রতি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলা দেশটিকে আবারো বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। একদিকে সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ওঠানামা অব্যাহত রয়েছে এবং চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আসমা শিরাজির মতে, বাকি বিশ্বের পাশাপাশি পাকিস্তানের জনগণের নিজেরও দেশটিকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, পাকিস্তান এমন একটি দেশ যার সীমান্ত এলাকা শান্তিপূর্ণ নয়। পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক শক্তি রয়েছে যা পশ্চিমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা জরুরি।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এটি এমন একটি দেশ যেখানে বিপুল সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। এই দেশের সীমান্তে সংঘাত রয়েছে, অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে রয়েছে গভীর বিভাজন। এই নির্বাচনী সংকট দেশের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল থেকে মনে হচ্ছে যে দেশের পরবর্তী সরকারও জোট দলগুলোর দ্বারা গঠিত হবে এবং কোনও একক দলের আধিপত্য থাকবে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর একসঙ্গে বসার এবং আলোচনা এবং আসন্ন নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি ব্যবস্থা তৈরি করার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।