এটা অত্যন্ত একান্ত অনুভূতি হয়ে দাঁড়ায় যখন আপনি দেখেন, আপনার দেশের নেতা আর আপনাকে চাচ্ছেন না। কারণ, আপনি মুসলিম; আর এটা এখন ‘হিন্দুরা প্রথম’ নীতিতে চলা ভারত। কতকিছু বদলে গেছে! দশকের পর দশক ধরে যারা বন্ধু ছিল, তারা বদলেছে। প্রতিবেশী আর প্রতিবেশীসুলভ সৌজন্য বিনিময় করছে না; তারা কোনো উৎসবে-উদযাপনে অংশ নিচ্ছে না; কষ্টের সময়ে দাঁড়াচ্ছে না পাশে।
শনিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। স্ত্রী উজমা আউসাফ আর চার কন্যাকে নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে থাকা সাংবাদিক জিয়া উস সালাম বলেন, ‘এটা এখন নির্জীব এক জীবন।’ ৫৩ বছরের সালাম আগে একটি দৈনিকের চলচ্চিত্র সমালোচক ছিলেন। সংগীত, শিল্প আর চলচ্চিত্র নিয়েই কাটত তাঁর সময়। ছুটির দিনে বন্ধুর বাইকের পেছনে বসে যেতেন প্রিয় কোনো রেস্টুরেন্টে। তাঁর স্ত্রী উজমাও সাংবাদিক; লেখেন ফ্যাশন, খাবার ও জীবনযাপন বিষয়ে।
সালাম এখন শুধু অফিস ও বাসায় যাওয়া-আসা করেন; মনে নানা উদ্বেগ। কারণ, তিনি মুসলিম। সালাম ও তাঁর স্ত্রী উজমা তাদের মেয়েদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা এমন একটি দেশে বাস করছেন, যারা মুসলিম পরিচয়– কীভাবে তারা খায়, পোশাক পরে এবং তাদের ভারতীয়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে; কখনও এ পরিচয় মুছে দিতে চাচ্ছে। সালাম-উজমা সম্পতির বড় মেয়ে মরিয়ম স্নাতকের ছাত্রী।
ভারতে মুসলিমরা নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে আবাসনও। বাসা বদলানোর ক্ষেত্রে আবাসন এজেন্টরা আগে জানতে চান ওই পরিবার মুসলিম কিনা। মুসলিম হলে ভাড়া দিতে অনাগ্রহ দেখান।
সালাম বহুত্ববাদী ভারতে সবার সহাবস্থানের বিষয়টি স্মরণ করেন। তিনি দেশটির অভ্যন্তরে বিভেদ আর বাড়াতে দেখতে চান না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি চান, মরিয়ম যেন বিদেশে চলে যান। ভারতে এমন বিভেদের খেলা ক্ষণস্থায়ী– এমনটা মনে করেই সালাম নিজেকে সান্ত্বনা দেন।
তথাপি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লম্বা খেলায় ব্যস্ত। দীর্ঘ সময় ধরে চলা প্রান্তিক পর্যায়ের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে মূলধারায় এনে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ২০১৪ সালে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তখন থেকে তিনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ও শক্তিশালী গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে দুর্বল করতে থাকেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র দেশটির ঐক্যের পেছনে কাজ করেছিল, যদিও কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাত ঘটেছে।
মোদি ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে সামনে রেখে ডানপন্থি সংগঠনগুলো ভারতের সমাজকে পাল্টাতে শক্তি প্রদর্শন শুরু করল। তারা সাম্প্রদায়িক সংঘাতে উস্কানি দিতে লাগল, যা সরকার দেখেও না দেখার ভান করেছে। এসব ঘটনায় মুসলিমদের বাড়িঘর ভেঙে দেন কর্মকর্তারা; ধরে নিয়ে যান মুসলিম লোকজনকেই। গরুর মাংস পাচারের অভিযোগ তুলে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে সহিংস গ্রুপগুলো। মোদির দলের শীর্ষ নেতারাও সমাদৃত হিন্দু, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন।
ভারতের প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মান্ধতা যাচাই করা হয় না। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ষড়যন্ত্র তথ্য সম্প্রচার করা হয়। এতে বলা হয়, মুসলিম যুবকরা হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত হতে প্রলুব্ধ করছেন। মোদি ও তাঁর দল অবশ্য এসব বৈষম্যকরণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, তারা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করছেন, যা প্রত্যেক ভারতীয়কে সমান চোখে দেখেন। তবে নির্বাচনের প্রচারণায় গিয়ে খোদ মোদিই বারবার মুসলিমবিরোধী নানা বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করেছেন; তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে মন্তব্য করেছেন।
দিল্লির যে এলাকাটিতে সালাম থাকেন, সেখানে হিন্দু, শিখ ও মুসলিমদের বাস। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশুরা মন্দিরের সামনের খোলা স্থানে খেলা করে। সালামের প্রত্যাশা, ভারত আবার সেই আগের অবস্থানে ফিরবে; ধর্ম নিরপেক্ষতায় ফিরবে। চলমান নির্বাচনে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ বেশ প্রতিরোধের মুখে
পড়েছে।