নভেম্বর ১৫, ২০২৪

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে একটি এনজিও গ্রাহকদের প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এতে বিপদে পড়েছেন প্রায় তিন হাজার গ্রাহক।

দেওয়ানগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে ডাংধরা ইউনিয়নের কউনিয়ারচর বাজার।

সাত মাস আগে এ বাজারে শাখা অফিস স্থাপন করে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ (আইডিই) নামে একটি এনজিও। শুরু থেকেই এনজিওটি হতদরিদ্র মানুষকে আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে টিনশেড, আধাপাকা ঘর ও পুষ্টি প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু ভাতা দেওয়ার কথা বলে ডাংধরা ও চরআমখাওয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষকে সদস্য করে তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়।

গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহায়তা না দিয়ে হাজার তিনেক মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়ে গত অর্থবছরের ২৩ জুন এনজিওটি লাপাত্তা হয়। এতে গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। টাকা ফেরতসহ এনজিও কর্তৃপক্ষের প্রতারণার শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইডিই এনজিওটির দেওয়ানগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার রনি আহমেদ, অডিট অফিসার হিসেবে কামরুজ্জামান বন্ধন এবং ফিল্ড অফিসার হিসেবে রেজাউল করিম রেজা দায়িত্ব পালন করেন। তারা শুরুর দিকে স্থানীয়ভাবে ১৩ জন কর্মী নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। কর্মীদের মাধ্যমে প্রথম ধাপে ডাংধরা ও চরআমখাওয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ৩০০ দরিদ্র পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে কম্বল, ময়দা, তেল বিতরণ করেন। দ্বিতীয় ধাপে ১৫০ সদস্যের মাঝে টিনশেড ঘর দেওয়ার কথা বলে সদস্যপ্রতি ২৫ হাজার করে টাকা নেয়। তৃতীয় ধাপে ২ হাজার ৫০০ সদস্যকে ১৮ হাজার ৭২০ টাকা পুষ্টি ভাতা দেওয়ার কথা বলে সদস্যপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নেয়। চতুর্থ ধাপে ২৪০ জন সদস্যকে আধাপাকা ঘর দেওয়ার কথা বলে সদস্যপ্রতি ৪০ হাজার টাকা করে নেয়। পঞ্চম ধাপে ১০০ জন সদস্যকে টিউবওয়েল ও পাকা স্যানিটারি ল্যাট্রিন দেওয়ার কথা বলে সদস্যপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে নেয়। খসড়া হিসেবে পাঁচটি ধাপে ২ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এনজিওটি।

এক সময় প্রতিশ্রুত সহায়তা দিতে গড়িমসি বা সময়ক্ষেপণ করলে সদস্যদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে এনজিওটির কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে এ ব্যাপারে ওই এনজিওর মাঠকর্মী হারুনুর রশীদ বাদী হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

কয়েকজন মাঠকর্মী জানান, প্রাথমিকভাবে মানুষের মাঝে বিশ্বাস আনতে স্থানীয় ইউপি সদস্য বখতিয়ার হোসেন ভক্তসহ কয়েক সদস্যকে ঘর দেয়। একটি সূত্র জানায়, ওই এনজিওর বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন ইউপি সদস্য বখতিয়ার।

পাথরেরচরের শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, তিনি গরিব মানুষ। সরকারি জমিতে ঘর উঠিয়ে দিনযাপন করছেন। ঘর দেওয়ার কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেননি। পরে ওই এনজিওর কাছে ডাংধরা ইউপি চেয়ারম্যানের সিলসমেত স্বাক্ষর দেখে বিশ্বাস করেন। ছাগল বিক্রি করে ১৫ হাত টিনশেড ঘরের জন্য ২৫ হাজার টাকা দেন। কিন্তু তাঁকে শুধু ঘরের চাল দেওয়া হয়। সেটা দেখে তাঁর আশপাশের বেশ কয়েকজন ঘরের জন্য টাকা দেন।

সানন্দবাড়ী সবুজপাড়া গ্রামের কতিরন বেগম জানান, ওই এনজিওর লোক প্রথম দিন বাড়িতে এসে নাম লিস্ট করে গেছেন। তার পর এক দিন ঘর দেওয়ার কথা বলেন। সে সময় ৪০ হাজার টাকা চাইলে তিনি বিপাকে পড়ে যান। তিনি গরিব মানুষ। ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ঘরের আশায় চেয়েচিন্তে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এখন শুনছেন, তারা পালিয়ে গেছে। তাঁর মতো অনেকের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছে। তারা তাদের টাকা চান।

পাথরেরচর গুচ্ছগ্রামের সাবিনা পারভীন বলেন, তিনি অভাবি মানুষ। তাদের পার্শ্ববর্তী এক সদস্যকে ঘরের চাল দিয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করে অন্যের কাছে সুদে টাকা নিয়ে ২৫ হাত আধাপাকা ঘরের জন্য ঈদের আগে ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে কিছুই দেওয়া হয়নি। তাঁর মতো এ গ্রামের বেশ কয়েকজন ঘরের জন্য টাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ শিশু ভাতার জন্য টাকা দিয়েছেন।

আইডিই এনজিওর মাঠকর্মী হারুনুর রশীদের ভাষ্য, এনজিও কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে চিনতেন। তারা ঘর ও শিশু ভাতা দেওয়ার কথা বলে সদস্যদের কাছ থেকে টাকা এনে অফিসে জমা দিতেন। ১৩ জন মাঠকর্মীর মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজারের মতো সদস্যের কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে এনজিওটি।

ডাংধরা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ (আইডিই) নামে এনজিওটি যখন অফিস করে, তখন আমাকে জানায়নি। পরে জানতে পেরে আমি তাদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইউএনওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা বলে পাঠিয়েছিলেন। এরপর কী হয়েছে, তাঁকে তারা জানায়নি। পরে বিভিন্ন ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়ায় খোঁজখবর নিতে পারেননি। এখন শুনছেন, তারা পালিয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে এনজিও কর্তৃপক্ষকে কল করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

মডেল থানার ওসি বিপ্লব কুমার বিশ্বাস জানান, এ ব্যাপারে তাঁর কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স জানান, আইডিই নামে এনজিওটির নামে তাঁর কাছে অভিযোগ এসেছে। তাদের সঙ্গে ফোনে কথাও হয়েছে। কিন্তু তারা বিষয়টি সমাধান করতে আসেননি। এ ব্যাপারে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে ব্য

বস্থা নেওয়া হবে।

 

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...