দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের শেয়ারবাজারে গতি ফিরেছে। নির্বাচনের পর থেকেই প্রধান শেয়ারবাজারে সার্বিক লেনদেন ও সূচক বেড়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য শেয়ারবাজারবিমুখ বিনিয়োগকারীকে এখন বাজারমুখী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজারে টাকার সরবরাহ বাড়াতে ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্টব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি মেনে শঙ্কা থাকা স্বত্ত্বেও শেয়ারের দর কমার সর্বোচ্চ সীমা (ফ্লোর প্রাইস) প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসি বলছে, সরকারি শেয়ার অফলোডের পাশাপাশি নানা সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এতোদিন দর কমার আশঙ্কায় ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আরোপ করা ফ্লোর প্রাইজের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিপুল বিনিয়োগ আটকে যায়।প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিদেশীরাও ফ্লোর প্রাইসের সমালোচনা করে বাজার থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব কমে যাওয়া এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কারণে লগ্নিকারকরা ফের বাজারমুখী হচ্ছে। এতোদিন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে দূরে ছিল। এতো আর বিরোধী দলের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি নেই। সেই কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন নতুনভাবে বাজার টাকা লগ্নির সুযোগ খুঁজছে। আর সেটারই সুযোগ করে দিতে ৩৫টি কোম্পানি বাদে বাকিগুলোর ফ্লোর উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, করোনার পর শেয়ারবাজার যখন ভাল হচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। যার কারণে দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। বিদেশীদের আগ্রহ করতে সরকারের নেওয়া রোড শো এবং শেয়ারবাজারের নানা খাতের সংস্কারের কারণে বাজারে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। বিএসইসির উদ্যোগের ফলে বাজারটিতে এখন স্মল ক্যাপ ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড গঠিত হয়েছে। আর বন্ধ এবং লোকসানী কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন করে মূল মার্কেটে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খোদ বিএসইসির এসব উদ্যোগের কারণে বন্ধ কোম্পানি থেকে বিনিয়োগকারীরা মুলধন ফেরত পাওয়া শুরু করেছে। এখন বিএসইসি বিদেশী বিনিয়োগ টানতে ফ্লোর ওঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফ্লোর ওঠানোর সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের ৩৫টি কোম্পানি ছাড়া সব কম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে বাকি ৩৫টি কোম্পানি থেকেও ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হবে। শেয়ারবাজার নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। আগামীতে বাজার আরও গতিশীল হবে।
ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আগেই বলেছি, নির্বাচনের পরই ফ্লোর তুলে নেওয়া হবে। ইউরোপ-আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ সবাই এখন বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে চায়। অর্থনীতির রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার মানে আগামী দিনে অর্থনীতি আরো অগ্রসর হবে। তাই শেয়ারবাজারও সেই ধারায় নতুন মাত্রা পাবে বলে আশা করছি।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেরিতে হলেও বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইজের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছেন। আগামীকাল রবিবার থেকে নতুন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। এতে গতি ফিরবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তারা।
ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারের দামে বড় কোনো উত্থান-পতন হচ্ছিল না। এক জায়গায় দর আটকে থাকার কারণে এতোদিন ক্রেতাও মিলছিল না। দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস বহাল থাকায় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোও সংকটে পড়ে। বারবার বিএসইসির বিরুদ্ধে এসব প্রতিষ্ঠান আঙ্গুল তুলেছে কৃত্রিমভাবে শেয়ার দর আটকিয়ে রাখার জন্য। এখন আর সেই অভিযোগ করার জায়গা থাকল না বাজার সংশ্লিষ্টদের সামনে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নির্বাচনের পর থেকে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৫৪৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
আগের সপ্তাহে চার দিনে এক হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। এই হিসাবে গত সপ্তাহে লেনদেন বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে লেনদেন বেড়েছে ৩৭.৬০ শতাংশ। আর চলতি সপ্তাহের দুই দিন যথাক্রমে ৭৬৫ কোটি ও ৬৭৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৩০১ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছিল।
আর বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে এটি ৬ হাজার ৩১৮ পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিতে কোন সময়েই পারেনি শেয়ারবাজার। সামগ্রিক অর্থনীতিতে তেমন কোন প্রভাব রাখতে পারেনি। নতুন সরকার এই উদ্যোগই নিতে চাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি মেনে ফ্লোর ওঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয় না।
প্রথমবার ২০২০ সালের ১৯ মার্চে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করলেও তুলে নেওয়া হয় ২০২১ সালের ১৭ জুলাইয়ে। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গত বছরের ১ মার্চ সব শেয়ারের দরে নিচের সার্কিট ব্রেকার ২ শতাংশ বেঁধে দেয় সংস্থাটি। এ ব্যবস্থা কাজ না করায় গত বছরের ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে সংস্থাটি। পরবর্তী সময়ে শেয়ার লেনদেন ব্যাপক কমে গেলে সমালোচনায় পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এতোদিন শেয়ারবাজারে ভয় ছিল, ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নিয়ে কারণ ছাড়াই বড় রকমের দরপতন হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো কমে যেতে পারে। ফ্লোর প্রাইস সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হয়, কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন হয়ে গেছে। তাই এটা তুলে নেওয়ার ফলে শেয়ারবাজারে গতি ফিরে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে প্রথমে কিছুটা দরপতন হতে পারে। তবে তা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। শেয়ারবাজারের গতি সঞ্চার করতে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া জরুরি ছিল।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার কার্যকর হবে। আর ফ্লোর প্রাইসের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিশন আশা করছে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বাজারে গতি ফিরে আসবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে দেড় বছর ধরে ৮০ শতাংশ ব্রোকার হাউস পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না। সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে বাজারে গতি আসেনি। গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতির যে উন্নতি হয়েছে তার কোনো প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়েনি। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেলেও শেয়ারবাজার পিছিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নতুন কোম্পানি বাজারে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এই বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করলে বাজার সমৃদ্ধ হবে। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে, নয়তো স্বাভাবিক ধারায় আসা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. সাইদুর রহমান বলেন, বাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হলে বাজারের উন্নতি সম্ভব নয়। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার সাড়ে ৭ শতাংশ, এটা খুবই কম। করহার বাড়ানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সব সময় এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসছি, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সুতরাং ভালো কম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সংগ্রহীত – জনকণ্ঠ , অপূর্ব কুমার।