নভেম্বর ১৫, ২০২৪

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শেয়ারবাজারকে ঘিরে যেসব বিনিয়োগকারী আশার বীজ বুনেছিলেন, তারাই এখন শেয়ারবাজার ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। শেয়ারবাজারকে শক্ত ভিতের ওপর দাড় করাতে সরকারী উদ্যোগের কমতি না থাকলেও কারসাজিকারক এবং সুবিধাভোগী এক শ্রেণীর কূটচালে ভন্ডুল হচ্ছে যাবতীয় পরিকল্পনা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন।

আর তাদের পোর্টফলিও (পত্রকোষ) থেকে প্রতিনিয়তই  উধাও হচ্ছে টাকা। কখনও জেড ক্যাটাগরি আবার কখনও সরকারবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে শেয়ারের দাম কমাচ্ছে কুচক্রীমহল।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতির সব ধরনের সূচকই ইতিবাচক রয়েছে। গত মাসে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আগের তুলনায় বেড়েছে। এছাড়া নির্বাচন পরবর্তী যে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আসছে বলে জুজুর ভয় দেখানো হয়েছিল, সেটিও এখন কেটে গেছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ফের ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যখন দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে সেখানে পিছিয়ে পড়ছে শেয়ারবাজারের সূচক।

মূলত গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার কারণেই শেয়ারবাজারের এই করুণ দশা। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চাইলে ওই সব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে কঠোর  হতে পারে না। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিএসইসি চেষ্টাও করেছে কিন্তু তাতে সফল হয়নি।

সম্প্রতি দেশের শেয়ারবাজারে কোম্পানিগুলোর দর কমার সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) কয়েক ধাপে প্রত্যাহার করে নেয় বিএসইসি। শেয়ারবাজারে কার্যরত প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বড় বিনিয়োগকারীদের দাবি ছিল স্থিতিশীলতা ফেরাতে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করতে হবে। সবপক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি এটি প্রত্যাহার করে নেয়।

এরপর থেকে শেয়ারবাজারটি মোটামুটি ভালই চলছিল। তবে ভাল কোম্পানির পাশাপাশি মন্দ ও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কোম্পানিগুলোর দর অস্বাভাব্কিভাবে বাড়ছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কমিশন বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদে স্বার্থের কথাটি বিবেচনায় নিয়ে পরপর দুই বছর লভ্যাংশ না দেওয়া, নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা না করা, ছয়মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ এবং রিজার্ভের তুলনায় লোকসান বেশি এসব কোম্পানিকে পর্যায়ক্রমে জেড ক্যাটাগরিতে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ঠিক সুযোগ সন্ধানী যেন বিএসইসির এই নির্দেশনার সুযোগকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নির্দেশনা জারির পর থেকেই শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ দিয়ে অস্থির করে তুলছে। প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় শেয়ার দর ও লেনদেন কমছে। এভাবেই  বাজারবিমুখ হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিন পার করলেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজার পরিপক্ক আচরণ করছে না। তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদর এখন কেনার মতো লোভনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু ওইসব শেয়ারে ক্রেতা মিলছে না। উল্টো দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ ও লোকসানী কোম্পানিকে ঘিরে চলছে টানাটানি। এটি সুস্থ শেয়ারবাজারের কোন লক্ষণ নয়। আর জেড ক্যাটাগরি নিয়ে বিএসইসির সর্বশেষ নিদের্শনা শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক হলেও কুচক্রীমহল এটিকে অসৎ উদ্দেশে কাজে লাগাচ্ছে। সাধারন বিনিয়োগকারীদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শও দেন এই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজারকে গতিশীল করতে সরকারী উদ্যোগের কোন কমতি নেই। ওটিসির বন্ধ কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফেরানো, স্বল্প মূলধনী কোম্পানি নিয়ে পৃথক বোর্ড চালুসহ নানা সংস্কারমূলক কাজ করা হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ টানতে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুুইজারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে রোড শো’র আয়োজন করা হয়েছে। এখন রোড শো’র সুফলও পেতে শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারকে চাপে রাখতে কারসাজিকারকরা গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থির করতে চাচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এইসব অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহবানও জানান ওই কর্মকর্তা।

এদিকে বিএসইসি থেকে জানানো হয়েছে আপাতত জেড ক্যাটাগরিতে নতুন কোন কোম্পানিকে নামানো হবে না। তবুও চলছে নানা গুজব।

জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এই মুহূর্তে নতুন করে কোনো কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কমিশন নেয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী যেসব কোম্পানির শেয়ার থেকে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহার করা হয়েছে তার বাহিরে আর কোনো কোম্পানির ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়নি কমিশন।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সার্বিক সূচকটির অবস্থান ছিল ৬ হাজার ২৫৪.৫৪ পয়েন্ট। আর  সর্বশেষ ৭ মার্চ গত বৃহস্পতিবার  এই সূচকের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ১১২ পয়েন্ট। অর্থাৎ এই কয়েকদিনে  সূচক কমেছে প্রায় ১৪৩ পয়েন্ট। এইভাবে লেনদেন ৯১৬ কোটি টাকা থেকে কমে ৭০৩ কোটি টাকাতে নেমেছে। এই সময়ে দেশের অর্থনীতিতে আহামরি কোন পরিবর্তন আসেনি। তবুও টানা সূচক ও লেনদেন কমতে শুধুমাত্র নেতিবাচক প্রচারণা ও কারসাজির কারণে।

সূত্র – অপূর্ব কুমার , জনকণ্ঠ।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...