সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিককে মুক্ত করতে চূড়ান্ত হয়েছে পণের টাকা। বীমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে দরকষাকষির পর এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। তবে ঠিক কত টাকা জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে জলদস্যুদের দেওয়া হবে, তা প্রকাশ করা হয়নি। মুক্তিপণ কোন প্রক্রিয়ায় দস্যুদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে, এখন আলোচনা চলছে সেটি নিয়ে। এর পর ঠিক করা হবে কবে জিম্মি নাবিকরা মুক্তি পাবেন সেই দিনক্ষণ।
জানা গেছে, ঈদের আগেই জিম্মি নাবিকদের মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে রাখতে চাচ্ছে জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপ। সেভাবে কাজ করতে বীমা প্রতিষ্ঠানকে চাপও দিচ্ছে তারা। তবে জলদস্যুরা মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করতে চাচ্ছে না। মূলত মালিকপক্ষকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখতে এমন কৌশলে এগোচ্ছে জলদস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকদের মুক্ত করার বিষয়ে অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছে কেএসআরএম গ্রুপ। তবে মুক্তিপণের অঙ্ক কত, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না তারা।
এদিকে জলদস্যুরা ছেড়ে দিলে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এতে থাকা ২৩ নাবিকের বিকল্প আরও ২৩ নাবিককে প্রস্তুত করে রেখেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। এখন যারা জাহাজে আছে তাদের মানসিক অবস্থা যাচাই করে বিকল্প নাবিকদের সোমালিয়ায় পাঠাবে তারা। এখন যারা জিম্মি আছেন তাদের কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তখন বিকল্প নাবিকরা হাল ধরবেন জাহাজের।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করার ব্যাপারে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। কিছু বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। বীমা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমরা সে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর কিছু বলা যাবে না। জিম্মি নাবিকদের মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে আমরা সবাইকে জানিয়ে দেব।’ মুক্তিপণের মাধ্যমেই নাবিকরা মুক্ত হচ্ছেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মুক্তিপণ ছাড়া সোমালীয় জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার নজির নেই। দয়া করে আর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। কৌশলগত কারণে সব প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনই দিতে পারব না।’
নাবিকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি, জিম্মি নাবিকদের মুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাপের কারণে এবারে মুক্তিপণের টাকা পেতে জলদস্যুদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কোন প্রক্রিয়ায় তারা মুক্তিপণের টাকা পাবে, সে বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাই জিম্মিদের মুক্তির দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না তারা। তবে ঈদের আগে নাবিকরা মুক্ত হচ্ছেন না– এটি অনেকটা নিশ্চিত।’
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, মুক্তিপণ প্রদানের বিষয়টি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। জাহাজের মালিকপক্ষ প্রথমে যোগাযোগ করে বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বীমাকারী প্রতিষ্ঠান। মধ্যস্থতাকারীরা যোগাযোগ করে জলদস্যুদের প্রতিনিধির সঙ্গে। এই তিন পক্ষ পরস্পর আলোচনা করে মুক্তিপণের অঙ্ক ও প্রদান প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। মুক্তিপণের টাকা ভাগ হয় পাঁচ ভাগে। জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগ করে তিনটি স্তরে। এই ভাগ যায় মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের টাকা পরিবহন করে দেওয়া গ্রুপের কাছেও। ১৪ বছর আগে জলদস্যু আক্রান্ত হওয়া এমভি জাহান মণি জাহাজের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে এবং সেই টাকা ভাগ হয়েছে। সেবার মুক্তিপণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম। এবারও জাহাজ মালিকের হয়ে বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি।
আ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জলদস্যুরা ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করলেও সেই টাকার ভাগ যায় অন্য পক্ষের কাছেও। মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত পরিবহন সংস্থা টাকার একটি অংশ পায়। মূল টাকা তিন ধাপে ভাগ করে নেয় জলদস্যুরা। প্রথমে যারা জাহাজে উঠে তাদের মূল টাকা থেকে একটি নির্ধারিত অংশ বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়। ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ টাকা পায় প্রথম যারা জাহাজটি ছিনতাই করেছে সেই দল। বাকি টাকা ভাগ করে নেয় দ্বিতীয় ধাপে যারা জাহাজটি পাহারা দেয় তারা। জাহাজের জ্বালানি ও খাবারসহ পরিচালনাগত খরচ আলাদাভাবে হিসাব করে জলদস্যুরা। এমভি জাহান মণি জাহাজের ক্ষেত্রে আমরা এমন ভাগবাটোয়ারা হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। জানা গেছে, মুক্তিপণের টাকা দিয়ে সোমালীয় জলদস্যুরা পরিচালনা করে নিজস্ব স্টক এক্সচেঞ্জও। অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়। অভিযান সফল হলে পাওয়া যায় লভ্যাংশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বিনিয়োগকারী এই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এক মাসে ৭৫ হাজার ডলারও উপার্জন করেছে। এ জন্য জলদস্যু হতে আগ্রহী হচ্ছে সোমালিয়ার সাধারণ মানুষও।
নৌ বাণিজ্য অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ জানান, সোমালিয়ার উপকূল-সংলগ্ন সমুদ্রপথ বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট। অ্যাডেন উপসাগরের এক উপকূলে ইয়েমেন, অন্য উপকূলে সোমালিয়া, জিবুতি, ইরিত্রিয়া। বিশ্ব বাণিজ্যের বড় একটা অংশ এই জলপথে হয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলে জলদস্যুদের উৎপাত পুরো বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। ২০১০-১১ সালের দিকে মাত্রা ছাড়ায় জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য। সম্প্রতি আবার আলোচনায় আসছে সোমালীয় জলদস্যুরা। লোহিত সাগরে হুতিদের নিয়ে অন্যান্য দেশ ব্যস্ত থাকায় ভারত মহাসাগরের আশপাশে আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে তারা। তাদের আক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এ জন্য ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করার পর এখন পর্যন্ত তিনবার অবস্থান পরিবর্তন করেছে জলদস্যুরা।
ক্যাপ্টেন সাব্বির আরও জানান, গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজটি ছিনতাই করে জলদস্যুরা। জাহাজটি এখন সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করা আছে। জাহাজটিতে জলদস্যুরা ওঠার পরপরই একটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি দূরপাল্লার টহল জাহাজ মোতায়েন করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী। বাংলাদেশি জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নেওয়া পর্যন্ত সেটির কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান নিয়ে অনুসরণ করেছিল ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ। এর মধ্যে আবার ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মাল্টার পতাকাবাহী কার্গো এমভি রুয়েন উদ্ধার করে। এর দুই দিনের মাথায় পান্টল্যান্ড পুলিশ জানায়, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে রাখা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। পান্টল্যান্ড পুলিশ জলদস্যুদের দুই সহযোগীকে মাদকসহ আটকও করে। এমন চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকায় মুক্তিপণের জন্য মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করেছে জলদস্যুরা। এ ছাড়া চাপের কারণে সমাধানের পথেও এগোচ্ছে তারা
।