‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সিপিডির নীতি সংলাপে বক্তারা বলেছেন, দেশর অর্থনীতি সামলাতে সুশাসন দরকার। আসছে বছরের বাজেট নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির আলোচনায় উঠে আসে এমন মন্তব্য। রোববার গুলশানের একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক একটি নীতি সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা।
সংলাপটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় চলমান জনসম্পৃক্ত সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে বিরোধী দলীয় উপনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, জাতীয় সংসদের লাইব্রেরী কমিটির সদস্য এ. কে. আজাদ এমপি, নাগরিক প্লাটফর্মের কোর সদস্য ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, খুবই জটিল রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিরাজমান। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল। বাজেটকে সামনে রেখে আমরা সামাজিক ও সরেজমিন মতামত নিয়েছি। অর্থনীতিতে সমস্যার ত্রিযোগ ঘটেছে। যার মধ্যে বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। অর্থনীতিতে এখনও অতি মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এটা গ্রাম কিংবা শহর এবং খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের জন্য সত্য। সেহেতু প্রথম সমস্যা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, যা মানুষের জীবনমানকে আঘাত করছে।
দ্বিতীয়ত ঋণের পরিস্থিতি। সরকার বিদেশি উৎস থেকে যে টাকা নেয়, তার চেয়ে দেশীয় উৎস থেকে দ্বিগুণ টাকা ঋণ নেয়। এটার দায়-দেনা পরিস্থিতি ভিন্ন একটা ইঙ্গিত বহন করছে।
তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবৃদ্ধির যে ধারা ছিল, সেই ধারায় শ্লোথকরণ হয়েছে। এর সঙ্গে কর আহরণ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি এখনও ১০ দশমিক ১০ এর কাছাকাছি, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। পিছিয়ে পড়া মানুষের ভোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর মূল্যস্ফীতি সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে যেখানে মূল্যস্ফীতি কমছে, কিন্তু সেই সুফল বাংলাদেশে দেওয়া যাচ্ছে না।
জিপিডি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জিডিপির ৩৭ শতাংশ সরকারি ঋণের পরিমাণ এবং ব্যক্তিখাতে ঋণ ৫ শতাংশ। সবমিলিয়ে ৪২ শতাংশ ঋণ রয়েছে। এর ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এতদিন বলতাম বাংলাদেশ কখন বিদেশি ঋণ অনাদায়ি করেনি, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে সরকার ঋণের টাকা দিতে পারছে না, যার পরিমাণ অন্তত ৫ শতাংশ। আর জিডিপি হার ৪ শতাংশ, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের ওপরে। সেটা অর্জন করতে বাকি সময়ে জিডিপি হার হতে হবে ১০ শতাংশে ওপরে, যার বাস্তবায়ন অসম্ভব। কারণ বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ কমে এসেছে, অন্যদিকে ব্যক্তিখাত কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।
গবেষণার সারাংশ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, মানুষ তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। প্রথমত শোভন কর্মসংস্থান, দ্বিতীয়ত মানসম্মত শিক্ষা এবং সর্বশেষ সামাজিক সুরক্ষা। চার নম্বরে এসেছে পিছিয়ে পড়া মানুষের বৈষম্য কমিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা। বাজেট পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য হতে হবে সংবেদনশীল, তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। আমার কথা বাজেট যাই হোক, তার বাস্তবায়ন যেন যথাযথ হয়। যার কাছে দুই টাকা যাওয়ার কথা সেটা যেন তার কাছে যায়।
তিনি বলেন, বাজেট সম্পর্কিত সংসদের স্থায়ী কমিটি রয়েছে, তাদের যেন বৈঠক হয়। এর আগের সংসদে ওই ধরনের বৈঠক দেখা যায়নি। এছাড়া তিন মাস পরপর অর্থমন্ত্রীকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংসদে উপস্থাপন করতে হবে, যা এর আগে দেখা যায়নি।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি কমিটির সদস্য এ. কে. আজাদ এমপি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এসব অর্থের যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি জবাবদীহীতা নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়িয়েও কোনো কাজে আসবে না।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, উন্নয়ন অবকাঠামো খাতে বরাদ্দে বাড়লেও গুরুত্ব কমছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের মতো সামাজিক খাত, যা দ্বিতীয় প্রজন্মের বড় সমস্যা। সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ ও সুষম বণ্টনের গুরুত্ব তুলে ধরেন বক্তারা বলেন, রেওয়াজ অনুযায়ী অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হলেও বাজেট তৈরিতে গুরুত্ব পায় সুবিধাভোগী (প্রেসার গ্রুপের) শ্রেণির সুপারিশ। অনেক দিন থেকে বিশৃঙ্খলায় আর্থিক খাত। অর্থপাচার বাড়িয়েছে সংকট। এমন পরিস্থিতে অর্থনীতিতে বাগে আনতে দরকার সুশাসন আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জোরালো গুরুত্ব উঠে এসেছে আলোচনায়।