দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের অনিয়ম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো চেপে রাখা হলেও সরকার পতনের পর এসব অনিয়মের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকতে। আস্থার সংকট তৈরি হয় পুরো ব্যাংক খাতে। লুটেরাদের লুটপাটের খেসারত দিতে হচ্ছে সংকটে থাকা ইসলামি ধারার সব ব্যাংককে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে মানুষের আস্থার জায়গায় শীর্ষে থাকা ইসলামি ব্যাংকগুলো।
বিশেষ করে সঞ্চয়কারীদের মধ্যে আস্থা কমে যাওয়ায় ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত ক্রমাগত কমছে। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আমানত কমলেও বেড়েছে মোট বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোগুলোতে আমানত-বিনিয়োগ ইতিবাচক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ইসলামি ব্যাংকের ওপর মানুষের প্রবল আস্থা রয়েছে। এখনো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ইসলামি ব্যাংকগুলো আবারও শীর্ষস্থান দখল করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। যা গত জুন শেষে ছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। তবে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে আমানত কমলেরও প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোজগুলোতে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন , ইসলামি ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এই সংকটাবস্থায়ও আমরা নতুন আমানত সংগ্রহ করছি। ইসলামি ব্যাংকগুলোতে একটা প্যানিক তৈরি হয়েছিল। যার কারণে অনেক গ্রাহক একসঙ্গে টাকা তুলতে এসেছিল। এখন এক দিনে যদি সব মানুষ টাকা তুলতে আসে তবে তো কোনো ব্যাংকই তা দিতে পারবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের যে তারল্য সহায়তা দিয়েছে তা যদি সময়মতো পাওয়া যেত তবে এই সংকট তৈরি হতো না। আমরা যদি গ্রাহকের চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিতে পারতাম তবে তারা আবারও ব্যাংকেই টাকা রাখত। এখন আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি খুব শিগগিরই সংকট কেটে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। যা গত জুন মাস শেষে ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে বিনিয়োগ বেড়েছে ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আলোচিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর কোনো বিনিয়োগ সামান্য কমেছে। বেড়েছে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোজগুলোতে।
গত ১৯ আগস্ট বিগত সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে এস আলম গ্রুপ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলÑ এমন ৬ ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শতভাগ মার্জিন ছাড়া নতুন করে এলসি (ঋণপত্র) না খোলারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামি ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। তবে গত ৫ ডিসেম্বর এই ছয় ব্যাংকের এলসি খোলায় শতভাগ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে আমানত কমলেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ে বেড়েছে আমদানি ও রপ্তানি। গত জুন প্রান্তিকে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর রপ্তানির স্থিতি ছিল ২৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে রপ্তানি বেড়েছে ৭ হাজার ১১১ কোটি টাকা। পাশাপাশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানিও বেড়েছে। গত জুন শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমদানির স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৬১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে আমদানি বেড়েছে ৪ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোত বড় উল্লম্ফন প্রবাসী আয়ে। শত সংকটের পরও ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আস্থা রেখেছেন প্রবাসীরা। তথ্য বলছে গত জুন শেষে ইসলামি ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের স্থিতি ছিল ২৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্সের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে বেড়েছে ৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ২৮ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়ার সরকার বলেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোতে সব থেকে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। অথচ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে খেলাপির বিষয়ে আরও কঠোর পলিসি আছে। ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী যদি কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয় তবে প্রথম পদক্ষেপ তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাকে আটক রেখে খেলাপি আদায় করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এ সবের আমরা কখনো বাস্তবায়ন দেখি নাই। এখন গভর্নর কিছুদিন আগে অ্যাসেট একুইজিসনের (সম্পদ অধিগ্রহণ) কথা বলেছিলেন। খেলাপিদের যাদের সম্পদ আছে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এটার যদি একটা নজির স্থাপন করতে পারে তবে খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ আদায় করা সম্ভব হবে। তরল্য আবারও স্বাভাবিক হবে।