চীনে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। দেশটিতে এর আগে করোনার এত বেশি সংক্রমণ দেখা যায়নি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, চীনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডব্লিউএইচও খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনকে সহায়তা করছি। এমনকি আমাদের পক্ষ থেকে চীনা নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় সহায়তার প্রস্তাব অব্যাহত থাকবে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। বর্তমানে দেশটিতে ছড়াচ্ছে ভাইরাসটির নতুন ধরন বিএফ.৭। এটি ওমিক্রনের বিএ.৫ এর একটি উপধরন। উচ্চ সংক্রামক নতুন ধরনটি চীনে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এ কারণ কী?
বিএফ.৭ ধরন
বিএফ.৭ ধরনটি অতি সংক্রামক এবং ভাইরাসটি, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংক্রমিত করে ফেলে। করোনায় আক্রান্তদের আবারও আক্রান্ত করা এবং ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও নতুন ধরনে সহজে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন।
সেল হোস্ট এন্ড মাইক্রোব নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএফ.৭ ধরনটি চীনের উহানে সৃষ্ট করোনার প্রথম ধরনের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ গুণ শক্তিশালী (নিউট্রাইলাজেশন রেসিসটেন্ট)। আর এর মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে ভ্যাকসিন নেওয়া উচ্চ রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরাও সহজে নতুন ধরনটিতে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন।
এদিকে চীনের প্রতিবেশী ভারতে এখন পর্যন্ত বিএফ.৭ ধরনে আক্রান্ত চারজন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দুইজন গুজরাট ও দুইজন উড়িষ্যার বাসিন্দা। ভারত ছাড়াও জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ডেনমার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন করোনার নতুন ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন।
নতুন ধরনটি আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে। এছাড়া উপসর্গ হিসেবে জ্বর, গলা ব্যাথা, সর্দি এবং কাশি দেখা দেয়।
চলতি ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সরকার ‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে সরে আসার পর চীনে করোনার দৈনিক সংক্রমণে যে উল্লম্ফন শুরু হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে সুনামিতে রূপ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, করোনাভাইরাসের নতুন কোনো ধরনের প্রভাবেই এই পরিস্থিতির মুখে পড়েছে দেশটি।
করোনা মহামারি ইস্যুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে চীনের অবস্থান স্বতন্ত্র। ২০২০ সালে করোনা মহামরি শুরুর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার একাধিক ঢেউ সহ্য করেছে, আবার সাধ্যমত গণটিকাদান কর্মসূচিও পরিচালনা করেছে। এসব কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক এমআরএনএ প্রযুক্তির লাখ লাখ ডোজ টিকা।
অন্যদিকে চীন করোনার দৈনিক সংক্রমণ ঠেকাতে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন প্রভৃতি কঠোর করোনাবিধি জারি রাখার ক্ষেত্রে যতখানি জোর দিয়েছে, সেই তুলনায় টিকাদান কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিয়েছে কম।
দেশটির গণটিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়েছে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত করোনা টিকা, যেগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা এমআরএনএ টিকার চেয়ে নিম্ন।
জনগণের নিম্ন শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের আবির্ভাবের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে— উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গেইসেল স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক এবং ইনফেকশান ডিজিজ সোসাইটি অব আমেরিকার ফেলো ড্যানিয়েল লুসেই মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘সামনের দিন, সপ্তাহ ও মাসগুলোতে চীনে করোনার ওমিক্রন গোষ্ঠীর একাধিক ভাইরাসের আবির্ভাব যে ঘটবে— তা পুরোপুরি নিশ্চিত। এই মুহূর্তে চীনের সরকারের যা করা উচিত— তা হলো বর্তমানে দৈনিক আক্রান্ত করোনা রোগীদের প্রত্যেকের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করা। তাহলেই জানা যাবে— ইতোমধ্যে নতুন কোনো ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছে কিনা।’
ড্যানিয়েল লুসেই বলেন, ‘২০২০ সালের শেষ দিকে ভারতে যখন করোনার ডেল্টা ধরনের আবির্ভাব ঘটল— খুব শিগগিরই সেটি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল; কিন্তু বিভিন্ন দেশের প্রতিরোধী তৎপরতার কারণে এক পর্যায়ে আমরা সেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।’
‘চীনের বর্তমান করোনার ঢেউ প্রতিরোধ করতে হলে অবিলম্বে জিনোম সিকোয়েন্সিং কর্মসূচি শুরু করা উচিত দেশটির সরকারের।’
তবে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত কিরবি ইনস্টিটিউটের ভাইরাসবিদ স্টুয়ার্ট টারভিল্লে অবশ্য ‘নতুন ধরনের আবির্ভাব’ তত্ত্বে পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। ব্লুমবার্গকে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চীনের বর্তমান অবস্থা জন্য করোনার সম্ভাব্য নতুন কোনো ধরন দায়ী হতেই পারে, তবে আমার মনে হয়— গত আড়াই বছরে দেশটি যেভাবে মহামারি মোকাবিলা করেছে, সেখান থেকে হঠাৎ সরে যাওয়ই দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।’
‘কারণ, ইতোমধ্যে আমরা জানি করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনটি মূল করোনাভাইরাস বা এটির অন্যান্য সব ধরনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সংক্রামক।’
টারভেল্লির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইরাসবিদ অ্যালেক্স সিগালও। দেশটির ডারবান শহরের আফ্রিকা হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এই কর্মকর্থা বলেন, ‘চীনের পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের মতো নয়। করোনা প্রতিরোধে যে পরিমাণ শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা প্রয়োজন, তা দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। কেবল নতুন ভাইরাসের আগমন ঘটলেই সংক্রমণে উল্লম্ফন হয়— এমন ধারণা সঠিক নয়।’
চীন অবশ্য নতুন ধরনের আগমনের সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখছে না। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ভাইরাল ডিজিজ কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক জু ওয়েনবো মঙ্গলবার বেইজিংয়ে এক সংবাদসম্মেলনে জানিয়েছেন, ওমিক্রনের যতগুলো উপধরনের জিনোম সিকোয়েন্স চীনের পরীক্ষাগারে আছে, নতুন আক্রান্ত রোগীদের নমুনা সেইসব সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।