নভেম্বর ২৬, ২০২৪

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না ব্যাংকগুলো। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, চাল, ডাল ও পেঁয়াজের মতো পণ্যেও শতভাগ নগদ অর্থ (মার্জিন) ছাড়া ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে না। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় এসব পণ্যে শতভাগ মার্জিন রাখা বাধ্যতামূলক নয়। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চায় ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, বর্তমানে যেকোনো পণ্য আমদানির জন্য এলসি করতে হলে শতভাগ মার্জিন চায় ব্যাংকগুলো। বিলাসী দ্রব্য কিংবা নিত্যপণ্য নির্বিচারে এ ধরণের নিয়ম করায় ছোট ও মাঝারি শ্রেণীর আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ সুযোগে বড় আমদানিকারকরা একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

তথ্য মতে, বিগত ২০২২ সালের ৪ জুলাই কিছু পণ্য আমদানিতে শতভাগ নগদ মার্জিন রাখার নির্দেশনা দেয়। নতুন শর্ত অনুযায়ী, বিলাসবহুল পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে হলে ১০০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। এর আগে ৭৫ শতাংশ মার্জিন ছিল। এছাড়া অন্যান্য এলসির ক্ষেত্রে মার্জিন হার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে আমদানির এলসির নগদ মার্জিন গ্রাহকের নিজের অর্থ থেকে পরিশোধ করতে হবে; এজন্য কোনো ধরনের ঋণ ব্যাংক পাবে না।
ওই সার্কুলারের ২ এর খ ধারায় বলা হয়েছে, ‘তবে শিশু খাদ্য, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জ্বালানী, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানির ঋণপত্র এ নির্দেশনার বাইরে থাকবে।’

অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে শতভাগ মার্জিন সুবিধা শিথিল রাখার কথা স্পষ্ট বলা থাকলেও ব্যাংকগুলো মানছে না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুষ্পষ্ট করে একটি নির্দেশনা জারির প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যাংকগুলোর এ ধরণের সিদ্ধান্তের কারণে ছোট ব্যবসায়ীরা বর্তমানে এলসি করতেই পারছে না। ফলে নিত্যপণ্যে সিন্ডিকেট বাণিজ্য বাড়ছে। অর্থাৎ যাদের টাকা আছে এমন বড় বড় শিল্প গোষ্ঠী একতরফাভাবে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে চিনি প্রতিকেজি দাম কমবেশি ৪০-৪৫ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৫-৬০ টাকা। একই চিনি বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ টাকা। ব্যক্তিশ্রেণীর আমদানিকারকদের এ সুবিধা দিলে বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে। এতে চিনির বাজারে কেউ সিন্ডিকেট করতে পারবে না।

এদিকে দুই দেশে দামের এমন পার্থক্যের কারণে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রচুর ভারতীয় চিনি ঢুকছে বাংলাদেশে। ৪ মে নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভা থেকে ৬২৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ১৩ মে রাতে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ১ হাজার ২৯২ বস্তা ভারতীয় চিনি। এভাবে দু-এক দিন পরপর সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে ভারতীয় চোরাই চিনি। সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসা এসব চিনি উচ্চ মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে।

অথচ যদি বাংলাদেশের আমদানিকারকদের স্বল্প মার্জিনে চিনি আনতে দেওয়া হতো, তাহলে বড় বড় শিল্প গোষ্ঠীর কাছে বা চোরাই কারবারিদের হাতে চিনির বাজার জিম্মি হতো না। একইভাবে তেল-পেঁয়াজসহ সব ধরণের নিত্যপণ্যের বাজারে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

জানা গেছে, মূলত ডলার সংকট মোকাবেলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই সময় এ নির্দেশনা জারি করেছিল। বর্তমানে ডলারের সংকট ও দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো ৪ জুলাইয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব এবং বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশের মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অধিকতর সুসংহত রাখার লক্ষ্যে আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার পুনঃনির্ধারণ করা হলো।
ওই নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কোন কোন পণ্যে শতভাগ মার্জিন রাখতে হবে। যেমন- মোটরকার (সেডানকার, এসইউভি, এমপিভি ইত্যাদি), ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স, স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান ধাতু ও মুক্তা, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, প্রসাধনী, আসবাবপত্র ও সাজসজ্জা সামগ্রী, ফল ও ফুল, নন সিরিয়াল ফুড যেমন অশস্য খাদ্যপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়; যেমন টিনজাত খাদ্য, চকোলেট, বিস্কিট, জুস, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়, তামাক, তামাকজাত বা এর বিকল্প পণ্যসহ অন্যান্য বিলাসজাতীয় পণ্যের আমদানি ঋণপত্র জন্য ১০০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।

অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্যের ঋণপত্রের জন্য ৭৫ শতাংশ মার্জিন রাখতে হবে। তবে শিশুখাদ্য, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বীকৃত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও সরঞ্জামসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, উৎপাদনমুখী স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সরাসরি আমদানি করা মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল, কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য এবং সরকারি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর কোনো মার্জিন আরোপ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নিত্যপন্য আমদানিতে সরকারের ছাড় দেওয়া উচিত। এ বিষয়টি স্পষ্ট করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরেকটি সার্কুলার জারি করে দিতে পারে। তাহলে আর ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত করা। তাহলে সিন্ডিকেট এমনিতেই ভেঙ্গে যাবে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...