মাত্র কয়েক দিন হলো ভূমধ্যসাগরে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে বাংলাদেশিসহ ৮৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে ইতালির মানবিক সংস্থা ‘ইমার্জেন্সি’র উদ্ধারকারী জাহাজ ‘লাইফ সাপোর্ট’। ৩ মে সন্ধ্যায় তাদের উদ্ধার করা হয় বলে জানায় সংস্থাটি। উদ্ধারের ২০ ঘণ্টা আগে তারা লিবিয়ার জাওয়াইয়া উপকূল থেকে রওনা হয়েছিলেন। ছোট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে উঠেছিলেন এই অভিবাসনপ্রত্যাশিরা। নৌকায় কোনও খাবার বা পানীয় ছিল না। উদ্ধারকারী জাহাজ নৌকার কাছে পৌঁছালে উদ্ধারকর্মীরা দেখতে পান, নৌকাটিতে পানি ঢুকছিল। নৌকার যাত্রীদের মধ্যে শিশু ও সন্তানসম্ভবা নারীও ছিলেন।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এভাবেই ইতালি কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে যাচ্ছেন লাখো অভিবাসী। এই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৬৯ জন সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক, যা সংখ্যায় ২ হাজার ৬৭০ জন। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশকে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার তালিকায় শীর্ষে রেখেছে। বাংলাদেশের পরেই রয়েছে সিরিয়া, সাগরপথের অভিবাসীদের মধ্যে যাদের অনুপাত ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সংখ্যায় ২ হাজার ৮৪ জন।
এই তালিকায় আরও আছে— তিউনিশিয়া, মিশর, গিনি, পাকিস্তান, মালি, গাম্বিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া ও সেনেগালের মতো দেশ।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ ছিল। ২০২২ সালে ছিল তৃতীয় এবং এর আগে ২০২১ সালে এই তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এবার ফের তিন মাসে আবার এখন শীর্ষ অবস্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ।
ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৪১৮ জন অভিবাসী ইউরোপে পৌঁছেছেন, আর এদের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ৫২ হাজার ২৬ জন। তাদের মধ্যে ৫৪৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিখোঁজ অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়েই। আর স্থলপথে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ২ হাজার ৩৯২ জন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক অ্যামি পোপ মঙ্গলবার ঢাকায় তাদের ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২৪ প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানান, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১২ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক।
সমুদ্রপথে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা মূলত ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস ও মাল্টায় প্রবেশ করেন। তবে বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ইতালির পথ।
সংস্থাটির ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য বলছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গ্রিসে সবচেয়ে বেশি যায় আফগানিস্তানের নাগরিকরা। এরপর আছে সিরিয়ার নাগরিকরা। এই তালিকায় আরও আছে— মিশর, ইরিত্রিয়া, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনসহ আরও অন্যান্য দেশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অফিস ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, গত বছর ইউরোপে নতুন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে পাঁচ নম্বরে।
২০২৩ সালে ৪০ হাজারের কাছাকাছি বাংলাদেশি নাগরিক প্রথমবারের মতো ইউরোপে আশ্রয় নেওয়ার আবেদন করেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে আশ্রয় আবেদন করা ৭ হাজার বাংলাদেশির মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৩৮০ জনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। ওই বছর ইতালির সরকারের কাছে আশ্রয়ের মোট আবেদন করেছিলেন ১৪ হাজার ৫৯০ জন, যা ২০২২ সালের শীর্ষে ছিল। এই আবেদনের মধ্যে ৬ হাজার ৮২১ জনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ডাটা ডট ইনফো।
মানবপাচারের মতো ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, ভিজিট ভিসায় দুবাই, এরপর ইরান হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা ইউরোপে ঢুকতে বেশি মরিয়া থাকেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য মতে, গত কয়েকবছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ জনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা— এসব জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেকজন খরচ করেছেন তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা।
সমুদ্রপথে এরকম যাত্রাকে পাচারকারীদের ভাষায় বলা হয় ‘গেম’। ভূমধ্যসাগর হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের আগে অভিবাসীদের অপেক্ষা করতে হয় লিবিয়ার ত্রিপোলির উপকূলীয় এলাকার একটি ঘরে। কয়েকদিন দিন সেই ঘরে চলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার প্রশিক্ষণ। আর এখানেই শুরু হয় পাচারকারীদের ‘গেম’। ইতালি পৌঁছাতে পারা-না পারায় নির্ধারণ হয় এই ‘মরণ গেমের’ জয়-পরাজয়।
ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপ আছে এমন যেখানে প্রতিনিয়ত ‘গেম’-এর খবর প্রকাশ করা হয়। প্রতিদিন এই খবর প্রচার করে ‘সাফল্য’ দেখানো হয়, আর তাতে উদ্বুদ্ধ হন তরুণরা।
সরকারে উদ্যোগে দেশে মানবপাচারের ওপর করা প্রথম জাতীয় গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। এতে বলা হয়, সারা দেশে আদালত ও পুলিশের কাছে মানবপাচারের বিপুল সংখ্যক মামলা দায়ের করা হয়। ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন (পিএসএইচটিএ) এবং সাতটি বিভাগে প্রতিষ্ঠিত মানবপাচার-বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের পরিধি প্রসারিত করেছে। তারপরও মামলা চূড়ান্ত করা ও সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
মাদক ও অপরাধ বিষয়ক জাতিসংঘের কার্যালয় (ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম বা ইউএনওডিসি) তাদের ২০২০ সালের গ্লোবাল রিপোর্ট অন ট্রাফিকিং-এ জানায়, অর্থনৈতিক চাহিদার কারণে বাংলাদেশে মানবপাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ২০১০ এর দশকের শেষের দিকে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস করেছে, এরপরও গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক লোক সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ ও দারিদ্র্য সীমার ভেতরেই রয়ে গেছে।
এই রিপোর্টে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আয়-উপার্জনের ভালো সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের পাচারকারীরা প্রলুব্ধ করে।