মার্কিন নথি অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি বার্তা পাঠানো হয়। যেখানে তারেককে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তারেকের ঢোকায় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবের পক্ষে বিস্তারিত তুলে ধরা হয় ওই বার্তায়। নথিটি সম্প্রতি ক্লাসিফাইড হওয়ায় সামনে এসেছে।
নথিতে দেখা যায়, দূতাবাস অভিবাসন ও জাতীয়তা আইন ধারা ২১২(এফ) এবং রাষ্ট্রপতির ঘোষণা ৭৭৫০ মোতাবেক নিরাপত্তা পরামর্শও চায়। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে, রাষ্ট্রপতি বুশ ঘোষণা ৭৭৫০ স্বাক্ষর করেন “দুর্নীতিতে জড়িত বা সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের অভিবাসী বা অ-অভিবাসী হিসাবে প্রবেশ ঠেকানোর জন্য”।
নথিতে উল্লেখ করা হয়, তারেকের বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিশনের লক্ষ্যগুলোও ব্যাপকভাবে হুমকিতে পড়েছে। ঢাকা দূতাবাসের বাংলাদেশের জন্য তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার রয়েছে। গণতন্ত্রায়ন, উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের জায়গা না দেয়া। তারেকের দুর্নীতিতে তিনটি লক্ষ্য অর্জনই বিঘ্নিত হয়েছে। তার অর্থআত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কারণে আইনের শাসন ব্যাহত হয়েছে এবং স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলেছে।”
“চূড়ান্তভাবে, আইনের শাসনের প্রতি তার চরম অবাধ্যতা বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরিরে সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। সংক্ষেপে বলা হয়, বাংলাদেশে যা কিছু খারাপ তার বেশিরভাগের জন্যই তারেক ও তার সহযোগীদের দায়ী করা যায়।”
এতে আরও বলা হয়, “রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির জন্য তারেক দায়ী বলে দূতাবাস মনে করে। তার দুর্নীতির কারণে মার্কিন ঘোষণাপত্রের ৪ নম্বর ধারায় বর্ণিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।”
তবে তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা ও মা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়নি দূতাবাস থেকে। বার্তায় তারেক রহমানকে ‘কুখ্যাত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, যাকে সবাই ভয় পায়’ বলে বর্ণনা করা হয়।
বার্তায় তারেক জিয়া সম্পর্কে বলা হয়, “সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় এবং রাজনৈতিক পদ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে যত্রতত্র ঘুষ চাওয়ার জন্য তারেক জিয়া কুখ্যাত। দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতি এক দৃষ্টান্ত সে।” ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থআত্মসাৎ ও কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা চললেও তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয় বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা, “আমরা মনে করি তারেক জিয়ার বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট আছে। গত সেপ্টেম্বরে তার একটিতে যুক্তরাজ্য ভিসা দিয়েছে। ২০০৫ সালের ১১ মে ইস্যু করা অন্য একটি পাসপোর্টে পাঁচ বছর মেয়াদি (বি১/বি২ ভিসা) ভিসা লাগানো আছে। সরকার সেটি জব্দ করেছে বলে আমাদের ধারণা।
“তারেক কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলারের অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে বলে খবর রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জবানবন্দি দিয়েছেন, যিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন।”
তারবার্তায় বলা হয়, “একটি মামলায় তারেক আল আমিন কনস্ট্রাকশনের মালিক আমিন আহমেদকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় লাখ ডলার না দিলে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন খান, মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের মীর জহির হোসেন ও হারুণ ফেরদৌসিসহ অন্য অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলারের চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকির মামলা দিয়েছে।”
মার্কিন দূতাবাস বলেছে, “তারেকের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড শুধু স্থানীয় কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অনেকগুলো ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।” খবর একাত্তর টিভি।
সিমেন্সের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তারেক ও তার ভাই কোকো দেয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনের সাক্ষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিমেন্সের সব চুক্তির ক্ষেত্রে তারেক প্রায় দুই শতাংশ ঘুষ নিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তারেক রহমানকে সাড়ে সাত লাখ ডলার দেয়। তারেকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ ঘুষের অর্থ নিয়ে তা সিঙ্গাপুরে সিটিব্যাংকে রাখে। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা দূতাবাসকে জানিয়েছেন, মোনেম কনস্ট্রাকশন একটি কার্যাদেশ পেতে তারেক রহমানকে সাড়ে চার লাখ ডলার দেয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তথ্য রয়েছে যে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সানভীর সোবহানকে একটি হত্যা মামলা থেকে ‘রক্ষায়’ ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেন তারেক রহমান। বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক হুমায়ুন কবীর হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে একজন ছিলেন সানভীর। এ হত্যা মামলা থেকে সানভীরকে রেহাই দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তারেক ওই অর্থ নেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।