সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ভারতের নীতি। এর মধ্যেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বাংলাদেশ। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হওয়া অংশীদারিত্ব এখন আরও গভীর হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে দুই দেশের নেতাদের রয়েছে দৃঢ় অঙ্গীকার। এই লক্ষ্যেই ভারত কাজ করছে। ভবিষ্যতেও ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সকল ইস্যুতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে চলতে চায়।
বৃহস্পতিবার সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণে ‘মিট দ্য সোসাইটি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রণয় ভার্মা এ কথা বলেন। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ঢাকা গ্যালারির মিলনায়তনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
প্রণয় ভার্মা বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের অগ্রাধিকারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ভারত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পারস্পরিক সহযোগিতায় উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করছে উল্লেখ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার। প্রণয় ভার্মা বলেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য দুই দেশের অগ্রগতি ক্রমশ বিকাশমান।

বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অংশীদার বলে মন্তব্য করে প্রণয়ন ভার্মা বলেন, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের দীর্ঘ পথ চলায় বাংলাদেশ ও ভারত আজ বিশ্বে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বজুড়ে নন্দিত হয়েছে বাংলাদেশের উন্নতি ও অর্জন। ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, মহামারি, সন্ত্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত ও বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে একত্রে কাজ করেছে । জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা দুই দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও জনগণের মধ্যে সুদৃঢ় যোগসূত্র স্থাপন করতে চাই।

তিনি বলেন, গত ৫২ বছরে রাজনৈতিক মানচিত্র বদল হয়েছে, কিন্তু সংস্কৃতিতে এক রয়েছে। পরস্পরের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, একাত্তরের আত্মিক বন্ধন আজিবন অমর থাকবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস শোকের দিন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, সার্বভৌমত্ব অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৫২ বছর আগে তাদের অকুতোভয় আত্মত্যাগ চির অমর হয়ে থাকবে।

সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ও পদ্মশ্রী ভূষিত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অব.) বীর প্রতীক, শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)।

সভাপতির বক্তব্যে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি মহাকাব্য। এই মহাকাব্যকে আমাদের ধারণ করতে হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের এই কাজটি আমরা খুব কম করেছি। আমরা কিছু বই লিখেছি, কিছু স্মৃতিকথা লিখেছি, সেসব স্মৃতিকথায় অনেক ভুল-ভ্রান্তি আছে আমরা জানি। কিছু চলচ্চিত্র যুক্ত করার চেষ্টা করছি। সেই চলচ্চিত্রগুলো শিল্প হয়নি। এই মহাকাব্যকে শিল্পে পরিণত করতে হবে।

তিনি বলেন, ২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে, সমর্থন দিয়েছে। তারা আমাদের সহায়তা দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, গোলাবারুদ দিয়েছে, সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ভারত আমাদের স্বীকৃতির পর থেকে পুরো পরিবেশটা পাল্টে গেল।
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বিশেষ করে শেষ প্রান্তে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছে আমরা বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছি, তখন তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে শুরু করলো। তারা একটি খুনি দল গঠন করলো। যার নাম আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের কথা ভাবতে হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরে রাজকার-আলবদররা আছে অন্য নামে। তারা বুদ্ধিজীবী-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করে। এই জায়গা থেকে আমরা নিষ্কৃতি চাই। দেশটা যেন এদের দখলে না যায়, ওরা যেনো আমাদের সবকিছু ধ্বংস করে না দেয়।

লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অব.) বীর প্রতীক বলেন, আমরা তাদের বুদ্ধিজীবী বলছি, যারা বড় বড় শহরের যোগ্য লোক ছিলেন। কিন্তু ঢাকার বাইরে প্রতিটি গ্রামে বুদ্ধিজীবী হত্যা হয়েছে। কারণ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও বুদ্ধিজীবী। যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সেই বুদ্ধিজীবী। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকও বুদ্ধিজীবী হতে পারে। এই ব্যাপারটা আমাদের পীড়া দেয়। অনেক মাদ্রাসার শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে, কারণ তারা গণহত্যার পক্ষে ছিল না, ফতোয়া দিচ্ছে না বলে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোথায় হয়নি, যখন অন্যদেশের সেনাবাহিনী এসে আক্রমণ করে, সেটা দেখে দেশের মানুষ আনন্দে উৎফুলিত হয়। আমাদের দেশে এটা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের যুদ্ধ বিমান দেখে। মুক্তিযুদ্ধ একই সঙ্গে আমাদের ত্যাগের-দুঃখের, বীরত্বের, অর্জনের কাহিনি। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় অর্জন আর কখনো হয়নি। এত বড় বীরত্ব আর কখনো দেখা যায়নি। এত বড় যুদ্ধও আর হয়নি।

তিনি বলেন, রাজাকার-আল-বদররা এই দেশে মন্ত্রী হয়, এটা কি সহ্য করা যায়? প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। আমরা আমাদের সেই অপরাধবোধ, গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছি। এখনো যদিও অনেক যুদ্ধাপরাধী বেঁচে আছে। যতদিন পর্যন্ত তাদের বিচার করা না যাবে, ততদিন শান্তি নেই। আমি কোনোদিন আমার মন থেকে এই প্রতিহিংসা দূর করতে পারবো না।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যারা হত্যা করেছে, তারা যদি পাকিস্তানের সহযোগী না হতো, তাহলে তারা কখনোই এই হত্যাকাণ্ড চালাতে পারতো না। রাজাকার, আল-বদররাই এই জঘন্য কাজটি করেছে। তারা যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা না করত, তাহলে তারা নয় মাস যে গণহত্যা, নির্যাতন চালিয়েছে, তা কখনোই চালাতে পারত না।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্মরণ করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। সেসব দেশে অন্যদেশগুলো ত্রাণ, রাজনৈতিক, অস্ত্র, কূটনৈতিক, আন্তর্জাতিক সমর্থন দিয়েছে অন্য দেশ। কিন্তু সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধ কেউ করেনি। শুধু ভারত তাদের সৈন্য পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের আমরা স্মরণ করি। পাশাপাশি ভারতের সরকার ও জনগণ সেসময় আমাদের যে সমর্থন দিয়ে গেছেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *