সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

ডেঙ্গু মহামারি পর্যায়ে পৌঁছার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকে দায়ী করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের শুরু থেকে মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নিত না।

গতকাল রোববার রাজধানীর শেরাটন হোটেলে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এই অসন্তোষের কথা তুলে ধরেন বক্তারা। এদিকে, ডেঙ্গুতে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১ জনের মৃত্যু হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এতে উপস্থিত ছিলেন। তবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কেউ সভায় অংশ নেননি। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গঠন করা হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। পরবর্তী সময়ে ওই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে পাঁচটি প্রশ্ন রাখেন। এগুলো হলো–স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, মশা নিধন কার্যক্রম কি মনিটরিং হচ্ছে, সিটি করপোরেশনে কি কিটতত্ত্ববিদ আছেন এবং সারাবছর কি মশা নিধন কার্যক্রম চলে?

জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম চলে। সারাবছর কিছু না কিছু উদ্যোগ থাকে। তবে সিটি করপোরেশনের একার প্রচেষ্টায় এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা নিধন সম্ভব নয়।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান বলেন, ‘বাসাবাড়িতে পানির মিটার বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির মিটার একটি বক্সে থাকে, এর মধ্যে পানি জমে। এই বক্সে লার্ভা পেয়েছি অনেক বাড়িতেই।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যদি ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করেন, তাহলে মশা কমছে না কেন, ডেঙ্গু এত বাড়ছে কেন?’ সমন্বয়হীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবন ও চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছি, কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়। আমরা কাউকে দোষ দিচ্ছি না। ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব রয়েছে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ৭০ শতাংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসা নিচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে। অন্যরা যাচ্ছেন বেসরকারিতে। অনেকের প্লাটিলেট ও আইসিইউ প্রয়োজন হয়, অনেকে শুধু ওষুধেই সুস্থ হন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। সরকার গড়ে রোগীপ্রতি ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করছে। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ব্যয় করেছে সরকার।’

এডিস মশা নির্মূলে সিটি করপোরেশনের ওষুধের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মশা নিধনে যেভাবে ডোবা-নালায় স্প্রে হওয়া দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। স্কুলেও অনেক বাচ্চা আক্রান্ত হচ্ছে। কলকারখানায়ও যেন নিয়মিত স্প্রে হয়।’ এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. আহমেদুল কবীর সভায় অভিযোগ করেন, মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করোপরেশন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। তাই ডেঙ্গু এ বছর জটিল আকার করেছে। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে ধরন দেখা দিয়েছে, আগামী বছর আক্রান্তরা আরও বেশি শকে যাবে। অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ, আমাদের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি লেভেলে সংক্রমণ হচ্ছে।’ তার মতে, প্লাটিলেট এখানে ইস্যু নয়, ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট বড় ইস্যু।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘সবাই অনেক কাজ করছি, তাও রোগ বাড়ছে, রোগী মারা যাচ্ছে। কোথাও তো একটা ঝামেলা আছে। সে বিষয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘এডিস মশা নিয়ে গবেষণার জায়গায় একটা দুর্বলতা হচ্ছে– দেশে মেডিকেল এন্টোমলোজিস্ট আসলেই নেই। যারা কাজ করেন তারা হয় প্রাণিবিদ্যা ব্যাকগ্রাউন্ডের অথবা কৃষি থেকে এসেছেন।’ নিপসমের পক্ষ থেকে মেডিকেল এন্টোমলোজির ওপর একটি প্রোগ্রাম চালু করার কথা জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু তেমন ছিল না। এ বছর কোনো জেলা বাদ নেই। আমরা শহর অঞ্চলে এডিস এজিপ্টি নিয়ে কথা বলি; কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এডিস এলবোপিকটাস বেশি থাকে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয় না। এলবোপিকটাস কচু গাছের পাতায় জমা পানিতেও হতে পারে।’ তার মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম সারাবছর চালাতে হবে।

বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. বর্ধন জং রানা বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রতিরোধী টিকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, এই মুহূর্তে দু্টি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে একটি বৈঠক রয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে দ্রুতই টিকা অনুমোদন দেওয়ার উদ্যেগ গ্রহণ করা হবে।’

নিপসমের কিটতত্ত্ববিদরা জানান, মশার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। তাই ওষুধ প্রয়োগে কর্মীদের প্রশিক্ষিত হতে হবে। তারা যদি শুধু ওষুধ ছিটিয়ে যান এবং তা মশার কাছাকাছি না পড়ে তা হলে কোনো কাজ হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘স্কুলে প্রচারণা বাড়াতে হবে। অনেক বাচ্চা স্কুলে আক্রান্ত হচ্ছে।’ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘পরস্পর দোষারোপ না করে সমস্যা থেকে উত্তরণ জরুরি। এ জন্য সমন্বিতভাবে

কাজ করতে হবে।’

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *