কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১১) অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে গেছে। প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছেন। সবকিছু হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে তীব্র রোদে মানববেতর জীবন কাটচ্ছে তাদের। রয়েছে খাদ্য এবং পানিসংকট।
তবে দ্রুত রোহিঙ্গাদের খাদ্যসংকট নিরসনসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন।
গতকাল রোববার (৫ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
ছমুদা বেগম (৩৩) ১১নং ক্যাম্পের বাসিন্দা। অগ্নিকাণ্ডে তার ঘরবাড়িসহ আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাল বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত খাবার চোখে দেখেননি তিনি। ২ মেয়ে ও ৪ ছেলে নিয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের পাশে কাঠফাটা রোদে বসে আছেন তিনি।
ছমুদা বেগম বলেন, গরম বেশি। ছায়া না থাকায় বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। যদি ৪টি খুঁটি দিয়ে তার ওপর ত্রিপল দেওয়া যেত, তাহলে রোদ থেকে বাঁচতাম। অনাহারে খুব কষ্টে হচ্ছে।
শুধু ছমুদা বেগম নন বর্তমানে ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে ঘর হারানো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের একই অবস্থা।
সোমবার (৬ মার্চ) সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের পর ৯, ১০ ও ১১নং ৩টি ক্যাম্প পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ওপর শুধু ইট-পাথরের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ছাই সরিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজে দেখছেন। কেউ কেউ ঘরের দখল ধরে রাখতে পুড়ে যাওয়া ঘরের ওপরই বসে আছেন।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দউল্লাহ দাবি করেছেন, ১১, ৯ ও ১০ নং ক্যাম্পের ৮টি ব্লকের কয়েক হাজার ঘর ইতোমধ্যে পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এই ক্যাম্পগুলোর কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে আছে। আমাদের যদি একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে না দেয় গরমের কারণে অনেক রোহিঙ্গা অসুস্থ হয়ে পরবে। কাল থেকে অনেকে “ভাতের দানাও” চোখে দেখেনি।
গোলবাহার (৪০) নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে। তারা যেটা চেয়েছিল সেটাই হয়েছে। এই কথার কারণ জানতে চাইলে গোলবাহার বলেন, সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসা সদস্যরা এই ক্যাম্প ধ্বংস করতে চেয়েছিল। অবশেষে সেটা বাস্তবে রূপ পেল। তাদের কারণে আজ আমাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। এর আগেও এই ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই।
ঘর পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা নারী
১০নং ক্যাম্পের আমিসন (৩৩) নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, প্রচণ্ড গরম। গরম সহ্য করতে না পেরে ছেলেমেয়েরা কান্না করছে। একটু ছায়া থাকলেও ছেলেমেয়েদের রোদ থেকে বাঁচাতে পারতাম। এখানে গাছপালাও নেই। না হয় বাচ্চাদের গাছের ছায়ায় রেখে আমি জায়গাটা ধরে রাখতাম। কী করবো বুঝতে না পেরে সন্তানদের রোদ থেকে বাঁচাতে ক্যাম্পের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন বাবা।
ডি-ব্লকে খোলা আকাশের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে আছেন রোহিঙ্গা গৃহবধূ আসমা বেগম (৪০)। তিনি জানান, তার ঘর থেকে কিছুটা দূরে একটি ঘরে আগুন লেগেছিল। তখন হইচই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই সময় তার স্বামীও ঘরে ছিলেন না। পরে আশ্রয়শিবিরে ফিরে এসে দেখেন, তার ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা। তারাও চেষ্টা করছে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসাধ্য সহায়তা করতে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, গতকালের অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে গেছে। এর মধ্যে শতাধিক দোকান, ২০টির বেশি বেসরকারি সংস্থার হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদানকেন্দ্র, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র, ৩৫টি মসজিদ-মাদরাসা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে শুকনো খাবারের পাশাপাশি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে অগ্নিকাণ্ডটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল।
স্থানীয়দের দাবি, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার ও ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়েছে রোহিঙ্গারাই। তবে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আগুনের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহ এক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে আমর্ড পুলিশ ও পুলিশ। আটক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের পর বিস্তারিত বলা যাবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা।