ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫

সংবিধানের ১৫২(২) বিলোপের প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের করা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই অনুচ্ছেদ যোগ হয় সংবিধানে। এর মাধ্যমে পঞ্চম তপশিলে ৭ মার্চের ভাষণ, ষষ্ঠ তপশিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সপ্তম তপশিলে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের অংশ করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে যোগ হওয়ায় এ তিনটি তপশিলকে সংবিধানে না রাখার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।

গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয় অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হয়।

সংস্কার কমিশন সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের ৬৪টি সংশোধন ও পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। সংবিধানের প্রস্তাবনাও সংশোধনের সুপারিশ করা হয়। একাত্তরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে প্রস্তাবনার অংশ করার কথা বলা হয়। নতুন চারটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়।

তবে কীভাবে সংবিধানের সংস্কার হবে, তা বলা নেই সুপারিশ প্রতিবেদনে। বিদ্যমান নিয়মে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বড় অংশকে মৌলিক কাঠামো আখ্যা দিয়ে সংশোধনের অযোগ্য করেছিলেন। তবে আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার মামলায় এ অংশকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ফলে দু্ই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কমিশনের করা সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে তা আগামী সংসদ নির্বাচিত হওয়ার আগে সম্ভব নয়।

কিন্তু অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই সংস্কার চায়। আদালতের রায়ে গণভোট বিধান ফিরেছে। কিন্তু কীভাবে সংস্কার হবে– এ প্রশ্নে কমিশন সদস্য ফিরোজ আহমেদ সমকালকে বলেছেন, এ প্রক্রিয়া ঠিক করবে সরকার, অংশীজন তথা রাজনৈতিক দলগুলো। সংবিধান কীভাবে সংশোধন করা হবে, তা নির্ধারণ কমিশনের কাজ নয় বলে সুপারিশে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে যে কমিশন হতে যাচ্ছে, তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক করবে গণভোট, রাজনৈতিক ঐকমত্য নাকি পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন হবে।

সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ‘ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী’ সংক্রান্ত। একাত্তরের ২৬ মার্চ দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন থেকে বাহাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হওয়া পর্যন্ত; অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, অস্থায়ী বিধান জারি হয়েছিল, তার সব বৈধতা দেওয়া হয় এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। চারটি তপশিলে এগুলোকে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে কার্যকর রাখা হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ২০১১ সালে সংবিধানের ৫১টি অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনে। ১৫০(২) অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনে বিএনপির ৬৩ দফায় ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলোপ করা হয়। এতে বলা হয়, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৫০ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালকে অস্বীকার করা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ, তথাকথিত স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম সংযোজনের মাধ্যমে সংবিধানকে দলীয় প্রচারপত্রে পরিণত করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে যোগ করা পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তপশিল বাদ দিয়ে ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলোপের প্রস্তাব করেছে জামায়াতও। একই প্রস্তাব দেয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

বিএনপি দলটির অবস্থান অনুযায়ী, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। তবে আওয়ামী লীগ তা নাকচ করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এই দলটির ভাষ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে টেলিগ্রাম বা বেতার বার্তার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামেও তা পাঠানো হয়। এর সপক্ষে একাত্তরে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদকে দলিল বলে আওয়ামী লীগ।

তবে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারসহ অনেকেই এ দাবি নাকচ করেছেন। তাদের ভাষ্য, এমন কোনো ঘোষণার কথা তারা একাত্তরে জানতেন না। শেখ মুজিবের জীবদ্দশাতেও এমন তথ্য আসেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার তথ্য সামনে আনা হয়। তবে হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাহাত্তরের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা রাখা হয় সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সরকারের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করা একদলীয় শাসনে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক আইনে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। ২০১৪ সালে বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে নেন। তবে উচ্চ আদালত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে। শেখ হাসিনার পতনের পর রিভিউয়েও আপিল বিভাগ একই আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ বিচারপতিদের অপসারণ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই রয়েছে।

তবে সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছে, একে বিচারপতিদের অপসারণে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও অনুসন্ধানের অভিযোগ জুডিশিয়াল কাউন্সিলে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি এনসিসিও পাঠাতে পারবে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...