প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরসহ দেশের ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৫০টি শিল্পকারখানা ও অবকাঠামোর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। আজ রবিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব উদ্বোধন করবেন। বঙ্গোপসাগরের মিরসরাই উপকূলের তীরঘেঁষে জেগে ওঠা বিশাল চরাঞ্চলে অতি লবণাক্ততার কারণে ফসল ফলত না। তাই কয়েক হাজার একর আয়তনের এলাকাটিতে মূলত মাছ চাষ হতো আর ছিল গবাদি পশুর বিচরণক্ষেত্র। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই অঞ্চলটিই এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপ নিয়েছে। এক সময় ৫ হাজার একর জমি ঘিরে বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা শিল্পাঞ্চলটি এখন ৩৩ হাজার একরের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’, যার পুরোটাই গড়ে উঠেছে সাগর থেকে জেগে ওঠা জমিতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের চারটি কারখানার পাশাপাশি সিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের দুটি, মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাতটি এবং শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি শিল্প-কারখানার বাণিজ্যিক কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। সেই সঙ্গে আরো ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ২৯টি কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী, যেখানে কর্মসংস্থান হবে অন্তত ৩৯ হাজার মানুষের। উদ্বোধন করা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সড়ক, ভবন, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। এর মধ্যে ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে উন্নয়নকাজ চলমান। মিরসরাই-ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’। ইতিমধ্যে এ শিল্পনগরের মোট আয়তন ৩৩ হাজার একর জমির মধ্যে সরকারের কাছ থেকে ১৭ হাজার একর জমি বেজা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভূমি উন্নয়ন শেষে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৩ একর জমি দেশি-বিদেশি ১৩৬ বিনিয়োগকারীর মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত জমিতে মোট প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ৭ লাখ ৫২ হাজারে বেশি বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হবে বলে বেজা সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর এলাকায় প্রায় ১৫টি কোম্পানি নির্মাণকাজ শুরু করেছে। প্রকল্প এলাকায় এরই মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুতের সংস্থান হয়েছে। সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পৃথক সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় সাগরপাড়ে নির্মিত হচ্ছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। এই বাঁধও সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক কারখানা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইস্পাত, অটোমোবাইল, বস্ত্র কারখানা, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা, স্টিল কারখানা গড়ে উঠবে। বেজার তথ্য মতে, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরের উইলমার, ভারতের আদানি গ্রুপ এবং জাপানের নিপ্পন স্টিলের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশি শিল্পগোষ্ঠীগুলোও।
প্রধানমন্ত্রী আজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কর্ণফুলী ড্রাইডক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। কর্ণফুলী ড্রাইডক স্পেশাল ইকোনমিক জোন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে বাদলপুরা ও শাহ মীরপুর মৌজায় অবস্থিত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ( বেজা)-এর কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়া জমিতে এটি প্রতিষ্ঠা করে দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স। ড্রাইডকের নির্মাণ ব্যয় হিসাবে বিশ্বব্যাংক ৮০০ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করেছে। এই ড্রাইডকটি লম্বায় ২৮৫ মিটার এবং প্রস্থে ৫৬ মিটার। ডকে ১ লাখ টন ওজনের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত করা সম্ভব। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরো একটি ড্রাইডকের নির্মাণকাজও চলছে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারায় ‘কর্ণফুলী ড্রাইডক স্পেশাল ইকোনমিক জোনে’র অধীনে দুইটি জেটি নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জেটিতে আমদানী পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে এবং নিয়মিত চলছে লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রম। যা চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্যবাহী জাহাজের জট কমানো তথা উত্পাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে বহির্নোঙরে জাহাজের অপেক্ষার সময় হ্রাস পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। এই জেটিতে ১৭০ মিটার লম্বা দুইটি জাহাজ একসঙ্গে ভিড়তে এবং ১০ থেকে ১২টি জাহাজ এক সঙ্গে পণ্য খালাস ও কম করে হলেও দৈনিক ৬ হাজার টন ও মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টন পণ্য খালাস করতে পারে। এই ইকোনমিক জোনের আওতায় আরো দুটি জেটি ও কনটেইনার টামিনাল নির্মাণের জন্য ২০ দশমিক ৯৮ একর জমি বেজার মাধমে লিজ নেওয়াসহ কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের নিজস্ব জমিতেও আরো দুইটি জেটি নির্মাণ করা হবে।
আজ প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন একযোগে মোট আটটি ভেন্যু থেকে অনুষ্ঠিত হবে। ভেন্যুগুলো হলো গণভবন, ঢাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর ( মিরসরাই, চট্টগ্রাম), শ্রহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল (শ্রীহট্ট, মৌলভীবাজার), কর্ণফুলী ড্রাইডক এসইজেড (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম), মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চল ( সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ), জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল (জামালপুর সদর), সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ( সাবরাং, কক্সবাজার) ও হোসেন্দি অর্থনৈতিক অঞ্চল (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ)। অর্থনতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে শেষ হবে অনুষ্ঠান। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ১ হাজার ২০০ জাহাজ ও নৌযান নির্মাণসহ প্রায় ৮০০ জাহাজ মেরামত এবং ৫০টি ড্রেজার নির্মাণ করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। আজ বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুনের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের ওপর ভিডিও প্রদর্শন শেষে চট্টগ্রাম-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান রহমান বক্তব্য রাখবেন।