বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে আমি কখনোই এত বড় অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি।
সোমবার (৬ নভেম্বর) অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী যে স্থিতিশীলতা আসবে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকেও বাড়তি অর্থায়ন সুবিধা পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। আর নিচে নামার সুযোগ নেই। এখন ওপরের দিকে উঠতে হবে। ফলে আগামী ডিসেম্বরেই মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করবে।
ডিসেম্বরে এ হার কমে ৮ শতাংশে নামতে পারে। চলতি অর্থবছরের শেষদিকে তা ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এ চাপও কমে আসবে।
দেশ থেকে টাকা পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হুন্ডির চেয়ে ব্যবসার আড়ালে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার হয়। পাচারের অর্থে দুবাইতে ১৩ হাজার বাংলাদেশি কোম্পানি গঠন করেছেন। আর পর্তুগালে আড়াই হাজার কোম্পানি গঠন করেছেন বাংলাদেশিরা। এসব কোম্পানি গঠন করা হয়েছে পাচার করা অর্থে। দেশ থেকে আগে প্রতিমাসে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো। কঠোর তদারকির ফলে এখন তা কমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নতুন করে আর কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। নতুন কোনো তহবিলও গঠন করা হবে না। আগে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে বা তহবিল গঠন করা হয়েছে সেগুলো থেকে আদায়ের মাধ্যমে ঋণের স্থিতি বা তহবিলের আকার ছোট করে আনা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে আগে যে অস্থিরতা ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। আগামীতে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দেশে বিদ্যমান সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মতামত ও সুপারিশ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মতামত নিয়েছে। এবার নেওয়া হলো ইআরএফ নেতাদের মতামত।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিতি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সলিমুল্লা, ডেপুটি গভর্নর, অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ইআরএফের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমসহ অন্য নেতারা।
সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেন, পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সেজন্য অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সেগুলোর দামও বাড়ছে। সেজন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে ডলারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে। ঋণ চুক্তি হওয়ায় এ ঋণ পাওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই।
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হুন্ডির চেয়ে ব্যবসার আড়ালে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার হয়। যেমন: দুবাইতে ১৩ হাজার বাংলাদেশির কোম্পানি রয়েছে। এগুলো পাচারের অর্থে গড়া প্রতিষ্ঠান। একইভাবে পর্তুগালে আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
এসব অর্থের উৎস হচ্ছে পাচার। আগে প্রতিমাসে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো। পরবর্তী সময়ে নজরদারি বাড়ানো হয়। এজন্য এলসি বিল ৮ থেকে ৯ বিলিয়নের স্থলে ৪ থেকে ৫ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। এতে কিন্তু পণ্যের সরবরাহ কমেনি। তবে ডলারের প্রবাহ বাড়লে এলসি খোলার বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হবে।