নভেম্বর ১৫, ২০২৪

মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস লিমিটেডের (বিডি ওয়েল্ডিং) শেয়ার কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু ও তার ভাই আমিনুল হক শামীম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর জটিলতার ও উত্তরাধিকারীদের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির শেয়ার কিনে মালিকানায় আসছেন না।

এই দুই ভাই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েল টিউলিপ সী পার্ল হোটেল রিসোর্টস অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক। এছাড়াও মেয়র টিটুর ভাতিজা সামিউল হক সাফাও শেয়ার কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

অথচ ছয় মাস আগেরও অর্থাৎ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও দীর্ঘ দিন ধরে উৎপাদন বন্ধ ও অস্তিত্বহীন কোম্পানির ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকায় শেয়ার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের আগ্রহের কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা শেয়ার কেনা-বেচার জন্য অনুমোদনও দেয়। এরপর পর কোম্পানির মালিকানাধীন থাকা আইসিবির ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৯৯টি শেয়ার কিনতে গত ২৫ জানুয়ারি আইসিবি ও সি পালের এমডি ও পরিচালকদের মধ্যে চুক্তি সই হয়। কিন্তু এখন আর কোম্পানির শেয়ার কেনার আগ্রহ নেই তাদের। কোম্পানি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর ফলে দ্বিতীয় দফাও মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে না বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডসের। তার ২০১৯ সালের জুলাই মাসে, আলিফ গ্রুপ এটি অধিগ্রহণের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল, এই বিষয়ে, আইসিবি এবং আলিফ গ্রুপ কোম্পানির আইসিবি এর শেয়ার কেনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু জটিলতার কারণে তা দখলে নেয়নি দলটি।

সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চলতি বছরের জানুয়ারিতে নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে সম্পূর্ণ শেয়ার অধিগ্রহণের অনুমতি দেয়। অনুমোদনের পর আইসিবি এবং প্রধান উদ্যোক্তার শেয়ার অধিগ্রহণের জন্য শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করে।

কিন্তু প্রায় ছয় মাস পরও এখন পর্যন্ত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ভাই এখনও শেয়ার কেনেনি।

নতুন উদ্যোক্তাদের দাবি ২০১৭ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে কর বকেয়া বাবদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা ছিল প্রায় ১৭ কোটি টাকা। কিন্তু এনবিআর ২০২২ সালে এই বকেয়া দাবি করছে ৫০ কোটি টাকা। এছাড়াও কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা গত ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যু বরণ করেছেন। ফলে দুই জটিলতার কারণে রয়েল টিউলীপ সী পার্ল হোটেল রিসোর্ট অ্যাড স্পার মালিকরা শেয়ার কিনছে না।

এ বিষয়ে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সী পার্লের পরিচালক একরামুল হক টিটু বলেন, কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরে জন্য কমিশন অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু আইসিবি ও প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার হস্তান্তর চুক্তি এখনও স্বাক্ষরিত হয়নি।

তিনি বলেন, কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা ও সাবেক এমডি মারা গেছেন। ফলে উদ্যোক্তাদের উত্তরাধিকারীদের অসহযোগিতা, এনবিআরের কর জটিলতাসহ নানা জটিলতার কারণে এখন মালিকানায় কেনার আগ্রহ নেই।

কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা এসএম নুরুল ইসলামের ছেলে ও কোম্পানির সাবেক নির্বাহী পরিচালক এসএম রাশেদুল ইসলাম বলেন, আব্বা মারা যাওয়ার আগেই এমওইউতে স্বাক্ষর করে গিয়েছিলেন। এখনো আব্বুর নামেই শেয়ার রয়েছে। যারা শেয়ার অধিগ্রহণ করতে চায়, তারা এখনো শেয়ার হস্তান্তর করেনি। তারা শেয়ার নিবে কিনা এখনও কিছু জানায়নি।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মারা যাওয়ার আগে মূল উদ্যোক্তা এসএম নুরুল ইসলাম আগ্রহী পক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। কিন্তু এসএম নুরুল ইসলামের শেয়ারও নতুন মালিকের কাছে হস্তান্তর হয়নি।

নাম না প্রকাশের শর্তে আইসিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আইসিবি বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী শেয়ার হস্তান্তর চুক্তি সম্পাদনের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত করেছে, কিন্তু নতুন মালিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আসেনি। এছাড়াও তারা শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে কিছু করেনি।

এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, অস্তিত্বহীন কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে এমন খবর ছড়ি পড়ায় গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে শেয়ারটির দাম বাড়তে থাকে। গত বছরের ১০ অক্টোবর শেয়ারটির মূল্য ছিল ২২ টাকা। সেখান থেকে ১০ টাকা ৯০ পয়সা বেড়ে ১৩ নভেম্বর দাঁড়ায় ৩২ টাকা ৯০ পয়সাতে। এরপর শেয়ারটির দর আবার কমতে শুরু করে।

গত ২২ জানুয়ারি শেয়ারটির মূল্য দাঁড়ায় ২৫ টাকা ১০ পয়সা। সেদিন বিএসইসি কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তনের অনুমোদন দিয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পরায় তারপর দিন থেকে দাম বাড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় দফায় শেয়ারটির দর বেড়ে ২৯ টাকা ৭০ পয়সাতে দাঁড়ায়। এখন শেয়ারের দাম কমছে।

প্রতিষ্ঠানটির ৬৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ শেয়ারহোল্ডার। এই শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, গ্রুপটি মালিকানায় আসার জন্য নয়, একটি গ্রুপ আগে শেয়ার কিনেছিল কম দামে। তারপর বাজারে মালিকানা পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে দিয়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে সী পার্ল হোটেল রিসোর্টস অ্যান্ড স্পার উদ্যোক্তাদের যোগসাজশ রয়েছে।

১৯৯৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিডিওয়েল্ডিয়ের পরিশোধিত মূলধন ৪৩ কোটি ৩৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩০৫টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার সংখ্যা ৩১ দশমিক ১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা দশমিক ৭২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা ৬৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এক কমিশন সভায় বিডি ওয়েল্ডিংয়ের মালিকানায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন করে।

একই সাথে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের এমডির শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়। শেয়ার কিনে কোম্পানির পর্ষদে আসার পর পরিচালকরা কোম্পানিকে উৎপাদনে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা।

নিয়ম অনুসারে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে থাকা ৩১ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার ১৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং ১৭ টাকা দরে ইকরামুল হক টিটু, আমিনুল হক শামীম এবং ভাতিজা সামিউল হক সাফার কেনার কথা।

কোম্পানির তথ্য মতে, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩১ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে আইসিবির হাতে রয়েছে ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার। আর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম নুরুল ইসলামের মালিকানায় রয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার।

আইসিবির ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৯৯টি শেয়ার কিনতে গত ২৫ জানুয়ারি আইসিবি ও সি পালের এমডি ও পরিচালকদের মধ্যে চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুসারে আইসিবির ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার ইকরামুল হক টিটু ও আমিনুল হক শামীম ১৭ টাকা ৫০ পয়সা করে শেয়ার কেনার কথা।

আর সাবেক এমডির হাতে রয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার। কিন্তু ক্যানসারের আক্রান্ত হয়ে এমডি মৃত্যুবরণ করায় এমডির শেয়ার এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ২৫ লাখ ২৫৬টি শেয়ার ১৭ টাকা দরে ৪ কোটি ২৫ লাখ ৪ হাজার ৩৫২ টাকা দরে কেনার কথা আমিনুল হক, একরামুল হক এবং সামিউল হক সাফার। এরপর স্টক এক্সচেঞ্জ এমডির শেয়ার নিজেদের কাছে হস্তান্তর করবেন।

এমডির শেয়ার বিক্রির টাকা ব্রোকার হাউজের ডিপোজিটরি পার্টিসিপেটরি অ্যাকাউন্টে রাখা হবে। আদালতের অনুমতিক্রমে উত্তরাধিকারীদের কাছে অর্থ বিতরণ করে দেবে স্টক এক্সচেঞ্জ।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০১৯ সালের পর থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এমনকি গত তিন বছরের কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করেনি। ২০১৯ সালে সর্বশেষ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছিল।

৫০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনী কোম্পানির ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৪ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটি ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম ওয়েল্ডিং ইলোক্টোডস ম্যানুফেচারিং কোম্পানি।

এরপর স্বাধীনতা পরবর্তীতে কোম্পানিটি বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে নেয়। এরপর ১৯৮৪ সালে সরকার এটি হস্তান্তর করে এবং একজন সাবেক আমলার কাছে। তিনি সর্বোচ্চ দাতা হিসেবে এটি কিনে নিয়েছিলেন।

এরপর এটি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত একটি প্রাইভেট কোম্পানির ছিল এবং প্রায় ১২ বছর ধরে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ওরলিকনের জন্য ওয়েল্ডিং ইলেক্ট্রোড তৈরিতে নিয়োজিত ছিল, যা একটি প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং জুরিখের ওরলিকন ওয়েল্ডিং লিমিটেডের সাথে লাইসেন্সিং চুক্তির অধীনে।

১৯৯৯ সালে, কোম্পানিটি চট্টগ্রামে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ঋণ খেলাপির কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হলে এটি সংকটে পড়ে। সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য ২০১৬ সালে কোম্পানিটি চট্টগ্রামে অবস্থিত তার কারখানাটি বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের কাছে বিক্রি করে এবং ঢাকায় একটি নতুন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করে। যা একটি জমি কিনলেও কোম্পানি পরিচালনার জন্য একটি কারখানা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে ঢাকার জমিতে এর কোনো কারখানা নেই।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...