লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সামিট গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ১১২ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
এরমধ্যে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মালিকানা প্রতিষ্ঠান সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড লভ্যাংশ পরিশোধে ২০ শতাংশ উৎস কর, এবং সামিট কর্পোরেশনে শেয়ার থাকা সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল তার লভ্যাংশে ১৫ শতাংশ উৎস কর ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, পাঠানো এক বিবৃতিতে সামিটের একজন মুখপাত্র জানান, রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে এখনও যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘সামিট কখনো কর ফাঁকি দেয়নি। একবার নোটিশ পেলেই আমরা বরাবরের মতো বাংলাদেশের আইন সম্পুর্ণরূপে মেনে চলব।’
রাজস্ব বোর্ডের কর অঞ্চল-২ এর আওতায় করদাতা হলো সামিট পাওয়ার ও সামিট কর্পোরেশন।
কর অঞ্চল-২ এর কর কমিশনার ব্যারিস্টার মুস্তাসিম বিল্লাহ ফারুকী জানান, সামিটের দুই কোম্পানিকে দেওয়া উৎস কর ছাড় পর্যালোচনা করতে এনবিআরকে তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই ট্যাক্স জোনের দায়িত্ব নেওয়ার পরে, আমরা দেখতে পাই কিছু করদাতা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিল, ফলে এখাতের অন্যান্য করদাতারা বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা বলছিল।’
‘তখন আমরা জানতে পারি, উৎসে কর অব্যাহতির সুবিধাভোগী হচ্ছিল সামিট গ্রুপ— কিন্তু এই সুবিধা প্রদানের বিষয়টা যথাযথভাবে নথিবদ্ধ করা ও মেইনটেইন করা হয়নি। এটা নজরে আসার সঙ্গেসঙ্গেই আমরা এনবিআরকে বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখতে বলেছি’– ব্যাখ্যা করে জানান তিনি।
ফারুকী আরও বলেন, এমনভাবে এসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যাতে করে মনে হচ্ছে, এনবিআর কর্মকর্তাদের ওপর বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হয়েছিল
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বড় বড় কিছু শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। বৃহত্তর এই তদন্তের অংশ হিসেবেই কর ফাঁকির অভিযোগটি উঠে এসেছে।
রাজস্ব বোর্ডের সূত্রগুলো জানায়, সামিট পাওয়ারের শেয়ার মালিকানা, লভ্যাংশ ঘোষণা ও প্রদানের তথ্য ছয় সপ্তাহব্যাপী পরীক্ষা করে – তারা কর ফাঁকি দিয়েছে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সিআইসি।
এই তদন্ত শুরু হয় গত ২০ আগস্ট, শুরুতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সামিটের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্যতে। এসব তথ্য জানাতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়।
তদন্ত চলাচকালীন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল গ্রুপটির অন্যান্য কোম্পানির বিষয়েও খোঁজখবর শুরু করে। এজন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োজিত করে– প্রতিটি কোম্পানির তথ্য অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, অনুসন্ধানে যা জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে এই করফাঁকির ঘটনাটা ‘হিমশৈলের চুড়ামাত্র’। এই গ্রুপের অধীন অন্যান্য কোম্পানিগুলোর আরও অনিয়ম থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা দলের এক সদস্য বলেন, ‘এপর্যন্ত উদঘাটিত কর ফাঁকির মধ্যে এটি অন্যতম বড় হলেও, আমরা আশঙ্কা করছি— তদন্তে আরও দুর্নীতির চিত্র উঠে আসবে।’
আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১১৭ ধারা অনুযায়ী, সামিট পাওয়ার থেকে সামিট করপোরেশনকে দেওয়া লভ্যাংশের ওপর ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির দ্বিতীয় ১১ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী, বিদেশি প্রতিষ্ঠান সামিট ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সামিট কর্পোরেশনের ১৫ শতাংশ উৎস কর কর্তনের বিধান রয়েছে।
তবে, এনবিআর সূত্র এবং টিবিএসের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, আগের প্রশাসন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল এবং সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ স্থানান্তরের উৎস কর থেকে অব্যাহতি দিয়ে দুটি পৃথক স্পষ্টীকরণ ব্যাখ্যা জারি করেছিল।
এখন রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার সময় উৎসে কর কর্তন করেনি সামিট পাওয়ার।
সামিট পাওয়ারের পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার কাঠামো অনুযায়ী, ৬৩.১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট কর্পোরেশনের, ৩.৬৫ শতাংশ রয়েছে ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ১৮.৫২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ১৪.৬৪ শতাংশ শেয়ার হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।
অর্থবছর ২০১৯ থেকে অর্থবছর ২০২৪ পর্যন্ত সামিট পাওয়ারের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন পরীক্ষা করে কর্মকর্তারা জানতে পারেন যে, সামিট কর্পোরেশনকে দেওয়া লভ্যাংশে ৩১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা উৎস কর কর্তন করেনি কোম্পানিটি। সেক্ষেত্রে দৈনিক জরিমানা বা সুদ জমা হওয়ার কথা, যার ফলে এক্ষেত্রে করফাঁকির মোট পরিমাণ ৪৬৫.০৭ কোটি টাকা বলে সিআইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সামিট কর্পোরেশনের— সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রেও একইভাবে ফাঁকির ঘটনা উঠে এসেছে।
সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে প্রদত্ত লভ্যাংশের উৎস থেকে কর কর্তনের করার বিষয়ে সামিট পাওয়ার এনবিআর-এর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। তখন এনবিআর ২০২৩ সালের শুরুতে স্পষ্টীকরণে জানায়, সুবিধাভোগী অংশীদার হিসেবে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া লভ্যাংশ থেকে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না।
অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামিট পাওয়ার থেকে সামিট পাওয়ার ইন্টান্যাশনালকে সরাসরি লভ্যাংশই দেওয়া হয়নি।বরং, সামিট পাওয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে সামিট কর্পোরেশনকে। যা পরে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে পাঠানো হয়।
তদন্তে জানা গেছে, এনবিআরের স্পষ্টীকরণে এমন ব্যবস্থার কথা ছিল না, ফলে উৎসে কর কর্তন করতে হতো।
তদন্তে আরও জানা গেছে, দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি অনুযায়ী– ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত – সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৪৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা উৎসে কর কর্তন করেনি সামিট কর্পোরেশন।
এতে জরিমানা বা সুদসহ মোট করফাঁকির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
তদন্তের ফলাফল জানার পরে, সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎস কর অব্যাহতির সুবিধা প্রত্যাহার করেছে এনবিআর।
নতুন এক নির্দেশনায় এনবিআর জানিয়েছে, ‘সামিট পাওয়ার লিমিটেড থেকে সামিট কর্পোরেশন লিমিটেডকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসে ২০ শতাংশ কর প্রযোজ্য হবে।’
এছাড়া, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সামিট কর্পোরেশন থেকে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।
মুস্তাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, শেষপর্যন্ত এনবিআর এসব অব্যাহতি তুলে নিয়ে– উল্টো তা আরোপ করেছে। কারণ, এসব কর সুবিধা দেওয়ার সময়েও যথাযথ আইনি ভিত্তিও ছিল না। তিনি বলেন, যখন কোনো স্পষ্টীকরণও বাতিল হয়, তখন সেটির অধীনে দেওয়া অনুমোদনও অবৈধ হয়ে যায়। তাই এখন থেকে নতুন করনীতি কার্যকর হবে ।’
পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে সে সম্পর্কে ফারুকী বলেন, “এখন আমরা শুরু থেকে কর আদায়ের পদক্ষেপ নেব। প্রথমে ডিমান্ড নোটিশ দেওয়া হবে, পরে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে দরকারি আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, এটি বাস্তবায়নে আমরা সব ধরনের উপায় গ্রহণ করব।’
সিঙ্গাপুরের অন্যতম ধনী এবং সামিট ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আজিজ খানের বিরুদ্ধেও এর আগে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা– বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আজিজ খান ও তার পরিবারের ১১ সদস্যের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেন। এই পরিবারের আর্থিক লেনদেন নিয়ে দেশের একাধিক সংস্থার তদন্ত চলমান রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সামিট গ্রুপ জানিয়েছে, বাংলাদেশে তাঁদের ৯২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে সচল রয়েছে।
এতে বলা হয়, গ্রুপের ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২,২২৫ মেগাওয়াট। তবে গ্যাস সংকট ও সরকারের থেকে চাহিদা না থাকায় ১৬৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্র পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মালিকানাধীন ১৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৯৭৬ মেগাওয়াট। এরমধ্যে ৮০৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে।