সামগ্রিক কারণে বেড়েছে ডিমের দাম, সিন্ডিকেট নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সামগ্রিক অবস্থা এবং এ খাতে প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও চাহিদা এবং সরবরাহের কারণে দাম বেড়েছে, বলেছেন ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আয়োজিত এক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফাত উল্লাহ।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার সহ-সভাপতি মো. তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুধীর চৌধুরী প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন ফিড উৎপাদনকারীদের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি), মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারীদের সংগঠন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি), প্রান্তিক খামারি ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিআইএ), ওষুধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহকারীদের সংগঠন এনিমেল হেলথ কোম্পানীজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আহকাব), ভুট্টা, সয়াবিনসহ ইনপুট সাপ্লায়ারদের সংগঠন বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফিটা) এবং বিজ্ঞানী, স্পেশালিষ্ট, রিসার্চার ও একাডেমিশিয়ানদের সংগঠন ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি’স সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) নেতারা।
সভায় দাবি করা হয়, চাহিদার তুলনায় ডিমের সরবরাহ কম হওয়ার পাশাপাশি এ খাতে নানা ধরনের ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। এছাড়া গরমের সময় মুরগি খাদ্য খাওয়ার চেয়ে পানি বেশি খায় ফলে ডিমের উৎপাদন এ সময় অনেক কমে যায়।
প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ। তিনি বলেন, ১২ টাকার বেশি দামে ডিম বিক্রি করলে তাদের ধরা উচিত। তবে ডিমের দাম কখনও ১০টাকার নিচে নামবে না। কারণ ডলার যখন ৮৬ টাকা ছিল তখন প্রতিটি ডিম ৯-১০ টাকা বিক্রি করা হতো। বর্তমানে ডলারের দাম সরকারিভাবে ১০৯ টাকা হলেও ব্যাংক বিক্রি করছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা। ফলে ডলারের দাম ভবিষ্যতে কখনও ১০০ টাকার নিচে নামবে না, ডিমের দামও ১০ টাকা হবে না।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আয়োজিত এক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা
বিপিআইসিসির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময় ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী খামারিরা লোকসান করেছেন। উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়েও খামারিরা চেষ্টা করেছেন উৎপাদন সচল রাখতে। দেশের মানুষের জন্য পুষ্টি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে। এজন্য তাদের প্রশংসা পাওয়ার কথা ছিল অথচ খামারি ও উদ্যোক্তাদের ললাটে জুটেছে অপবাদ আর অপমান। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা অন্যায্য মুনাফা করেছে অথচ খড়গ নেমেছে উৎপাদকদের ওপর।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ডিম-মুরগির বাজারে সিন্ডিকেট! এমন অপপ্রচার ছড়ানোর কারণে বিভ্রান্তি দিন দিন আরও বাড়ছে। তাছাড়া ‘প্রান্তিক খামারি’ বনাম ‘করপোরেট খামারি’র বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমেও দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। ডিম-মুরগি আমদানি করা হলে তা দেশেরই ক্ষতি করবে।
তিনি বলেন, একদিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা যেখানে ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০-৮০ লাখ, বর্তমানে তা ১ কোটি ৩০ লাখে নেমে এসেছে। লেয়ার মুরগির চাহিদা ১১ লাখ থেকে কমে হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ।
মাহাবুবুর রহমান বলেন, ২০২২ সালে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছিল-এমন প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই উল্টো। লাভ তো দূরের কথা ব্রয়লার ও লেয়ার খামারিদের লোকসান হয়েছিল প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা।
ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ভুট্টা, সয়াবিন মিলসহ ফিড তৈরির অন্যান্য উপকরণ এবং ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি করা দূরূহ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এনওসি দিয়ে আমদানি করা ফিড গ্রেড পণ্যকেও ফুড গ্রেড লেবেল দিয়ে উচ্চহারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে; আবার মিস ডিক্লারেশনের অভিযোগে একইসঙ্গে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি বলেন, ডিমের দৈনিক উৎপাদন পাঁচ কোটি থেকে বর্তমানে চার কোটির নিচে নেমে এসেছে। প্রান্তিক ও ছোট খামারিরা মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশ ডিম উৎপাদন করছে।
তিনি বলেন, খামারিদের মাঝে ভয় নয় বরং আশা জাগিয়ে তুলতে হবে। বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি দিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি মূল্যে বাচ্চা, ফিড এবং ওষুধ দিতে হবে। পোল্ট্রি বিমাকে খামারিবান্ধব করতে হবে। সফল খামারিদের পুরস্কৃত করতে হবে। তাহলে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো আবারও চালু হবে।
এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আফতাব আলম বলেন, প্রায়ই খামার ও খুচরা বাজারের মাঝে বড় ধরনের ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১০.৭৫ টাকায় উৎপাদিত ডিমের সাথে ২টাকা যোগ করলেও খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম ১২ দশমিক ৭৫টাকার বেশি হওয়া সমীচীন নয় অথচ বাজারে তা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫টাকা এমনকি কোথাও কোথাও ১৭ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখা গেছে।
অনুষ্ঠানে পোল্ট্রি খাতে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ৭ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।