নভেম্বর ১৪, ২০২৪

সংসদের শেষ অধিবেশনে পাস হওয়া ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল-২০২৩’-এ সম্মতি দেননি রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। ফলে বিলটি আইনে পরিণত হচ্ছে না। বিলে সম্মতি না দিয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বর্তমান একাদশ সংসদের অধিবেশনের সম্ভাবনা না থাকায় বিলটি তামাদি হয়ে যাবে বলে সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই শ্রম আইনের সংশোধন চেয়ে আসছিল জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করা, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় শ্রম আইন কার্যকর করাসহ শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ে চাপ ছিল বাংলাদেশের ওপর।

এদিকে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে তা জানানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতির আলোকে বাংলাদেশে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি গত ২০ নভেম্বর শ্রম আইন সংশোধনের বিল ফেরত পাঠান। তবে তপন কান্তি বলেছেন, সম্প্রতি শ্রম আইনে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) আইনেও অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু চাওয়া ছিল। সেগুলো পূরণ করার জন্যই সংস্কার বা আইনের পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে সংশোধনের মধ্য দিয়ে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের। তাই সংসদের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বিলে সম্মতি না দেওয়ায় সংশোধনী কার্যকর হচ্ছে না।

গত ২৯ অক্টোবর শ্রম আইন সংশোধনের বিল সংসদে তোলা হয়। পরীক্ষার জন্য তিন দিন সময় দিয়ে তা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ২ নভেম্বর বিলটি পাসের পর সম্মতির জন্য ৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়।

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি কী কারণে সম্মতি দেননি তা ২২ নভেম্বর প্রকাশিত বুলেটিনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। কাজেই উক্ত দফা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন‌্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে দফাটি পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছে, তা বেআইনি ধর্মঘট বা লকআউটের দণ্ড সংক্রান্ত। এটি মূল আইনের ২৯৪ ধারা। এই ধারার ১ উপধারায় শ্রমিকদের বেআইনি ধর্মঘটের দণ্ডের কথা বলা আছে। আর ২ উপধারায় মালিকপক্ষের বেআইনি লকআউটের দণ্ডের বিধান আছে। উভয় ক্ষেত্রে দণ্ড একই। যেভাবে বিলটি পাস হয়েছে তাতে শুধু শ্রমিকদের বেআইনি ধর্মঘটের জরিমানা ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২০ হাজার টাকা হয়েছে। অন্যদিকে মালিকদের দণ্ড আগের মতোই রয়ে গেছে। কারণ উপধারা-২ সংশোধন হয়নি। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সংসদে বিল পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিলে তখন তা আইনে পরিণত হয়। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো বিল পেশ করার ১৫ দিনের মধ্যে তিনি তাতে সম্মতি দেবেন অথবা অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তার কোনো বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করে বার্তাসহ সেটি সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন।

সাধারণত রাষ্ট্রপতিকে কোনো বিল সংসদে ফেরত পাঠাতে দেখা যায় না। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সপ্তম সংসদে পাস হওয়া একটি বিল সই না করে সংসদে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপসচিব (আইন প্রণয়ন) নাজমুল হক জানান, চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন ইতোমধ্যে শেষ। তাই বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিলটি তামাদি হয়ে যাবে। আগামী সংসদে আবার নতুন করে বিল উত্থাপন করতে হবে।

এদিকে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেশে শ্রম অধিকার সংক্রান্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যলোচনায় বিশেষ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহছানে এলাহী, এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি কী প্রভাব ফেলবে এবং বিষয়টি সরকার কীভাবে দেখছে– এ প্রশ্নের উত্তরে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বিশ্বব্যাপী শ্রম পরিস্থিতি আরও উন্নত হোক। বাংলাদেশও শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিল্প মালিক বা রপ্তানিকারকরা এ বিষয়ে সচেতন। শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে গত ২০ সেপ্টেম্বর টিকফা ফোরামের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোন জায়গায় ঘাটতি রয়েছে, জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বলেন, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ– কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের ১০ শতাংশ চাইলেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ছিল, সংগঠন করার ক্ষেত্রে অন্তত ২০ শতাংশ শ্রমিককে সম্মত থাকতে হবে। অবশ্য পরে সংশোধন করে তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। ইতোমধ্যে এ কর্মপরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। যেটুকু বাকি আছে, পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন হবে। বর্তমানে বেপজা আইনেও সংগঠন করার সুযোগ রয়েছে। আইনে একে ‘ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র চায়, এখানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রবর্তন করতে হবে। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বেপজা আইন প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।

জিএসপি নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিবেদন বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বাণিজ্য সচিব বলেন, প্রতিবেদনে বাংলাদেশ যেসব সংস্কার হাতে নিয়েছে, তার প্রশংসা করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। আরও বেশি বাস্তবায়ন দেখতে চান তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশ যেহেতু শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, সেহেতু তাদের চাওয়া বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

যখন শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন ডাট গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে অন্দোলন চলছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় এক হাজার শ্রমিক শ্রম ভবনের সামনে গত দু’দিন আন্দোলন করছে। তাদের প্রায় ৭০ কোটি টাকার বেতন বকেয়া। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক অধিকার রক্ষা হচ্ছে হচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নে শ্রম সচিব এহসানে এলাহী বলেন, বিষয়টি নিয়ে শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। তাদের পাওনা আগামী মার্চ মাসের মধ্যে পরিশোধ করার অঙ্গীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন শ্রমনীতি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নন। কারণ শ্রমিক ইস্যুতে বাংলাদেশে কোনো সহিংসতা নেই। তার পরও শ্রমিক ইস্যুতে কারখানাগুলোকে আরও তর্ক থাকতে হবে।

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...