রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারত ও চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। আর রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।
রোহিঙ্গা সংকট: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ওভারসিস করেসপন্ডেন্টস বাংলাদেশ (ওকাব)।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কূটনৈতিক পথ বেছে নিয়েছে। একইসঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে গেছি। আমরা গাম্বিয়া ও ওআইসির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আরসিএজের) মামলা করেছি। সেই মামলায় এখন পর্যন্ত যে আউটকাম এসেছে, সেটি আমাদের পক্ষে। গাম্বিয়া বলেছে, মামলা সঠিক পথে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত এই মামলার ইতিবাচক আউটকাম আসবে।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, আইসিজের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারের ওপর পড়বে। আমরা ক্রমাগতভাবে চেষ্টা করেছি, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব দেশের প্রভাব মিয়ানমারের ওপর আছে, তাদের এই বিষয়ে যুক্ত করার। কয়দিন আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তার সঙ্গেও রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনায় সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু পরামর্শ তিনি আমাদের দিয়েছেন।
চলতি বছরে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে উগান্ডায় মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ওই বৈঠক থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়ানোর জন্য হলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু করতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাখাইন প্রদেশে এখন যে পরিস্থিতি, সেখানকার সেনাবাহিনী পালিয়ে আমাদের এখানে আসছে। এ পর্যন্ত ৭০০ এর বেশি সে দেশের সেনাবাহিনী ও বর্ডারগার্ড আমাদের দেশে পালিয়ে এসেছে। যেখানে ওদের নিরাপত্তা বাহিনী পালিয়ে আমাদের এখানে আসছে, এই পরিস্থিতিতে তো আমরা রোহিঙ্গাদের সেখানে ঠেলে দিতে পারি না।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিতে বলেছে। ক্যাম্পে তারা কিছু কাজ করছে। কিন্তু তাদের পুরোপুরি জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা আমরা কীভাবে দেব? ক্যাম্পের ভেতরে আমরা সীমিত কিছু কাজের ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু ক্যাম্পগুলো খুবই সংকীর্ণ ও জনাকীর্ণ। রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা সমাধান নয়। একমাত্র সমাধান হচ্ছে সব অধিকারসহ তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে স্বাগত জানাচ্ছে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না। এখনো যারা মিয়ানমারে আছে, তারা যদি বাংলাদেশে এসে এসব দেশে যেতে চায়, তাহলে কি হবে? কানাডা, আমেরিকা, ইউকে কিছু রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাচ্ছে। তারা সবাইকে কেন নিচ্ছে না?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত বছর রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন অনেক কমে গিয়েছিল। আগে মাথাপিছু ১২ ডলার ছিল। যা গত বছর ৮ ডলারে নেমে যায়। এ বছর ১০ ডলারের বেশি হতে পারে। গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া ও গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে ফান্ডিং কমে গিয়েছিল। এ বছর আমাদের চেষ্টায় ফান্ডিং মাথাপিছু ১০ ডলারের ওপরে যাবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আন্তর্জাতিক চাপ যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি এবং আইসিজে থেকে যদি একটি ভালো রায় আমাদের পক্ষে আসে, তাহলে মিয়ানমারের ওপর চাপ আরো বাড়বে। তখন মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু করবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো উচিত নয়।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মানবিক দিক ও প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জোর দেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখনো বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা। এই সংকটের আরো অনেক গভীরে যেতে হবে। যতদিন যাবে এই সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। তাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সমাধানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে একযোগে উদ্যোগী হতে হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের খুব কস্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের কক্সবাজার রোহিঙ্গাদের কাছে হারাতে হবে। কারণ বর্তমানে মাছ ধরা, কৃষিতে কাজ করাসহ যাবতীয় সবকিছুই রোহিঙ্গাদের কাছে চলে যাচ্ছে। স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপকভাবে ভারসাম্য হারাচ্ছে সেখানে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ওকাবের কার্যকরী কমিটির সদস্য ফরিদ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের অব্যাহত অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গারা মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, সন্ত্রাসী তৎপরতা, পাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অনেকে মানব পাচারকারীদের শিকার হচ্ছেন এবং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ভ্রমণের চেষ্টা করছে। এমনকি তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও এনআইডি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালে যেভাবে আন্তর্জাতিকমহল অর্থায়ন করতো এখন তা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর রোহিঙ্গা সঠিক প্রত্যাবাসনই হতে পারে একমাত্র পথ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করছে। রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরাই এখন উখিয়ায় সংখ্যালঘু। সেখান থেকে তারা শুধু টেকনাফ-কক্সবাজার নয় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর কোথাওই প্রত্যাবাসন একদিনে সবার সম্ভব হয়নি। আস্তে আস্তে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে প্রত্যাবাসন কার্যকর সম্ভব হয় বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ক্যাম্পগুলোতে আরশাসহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর কার্যক্রম বাড়ছে কি না তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। সামনে আরও চাপ আসতে পারে। সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
ওকাবের সভাপতি নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকা অফিসের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর তৌহিদ রোজ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, সাংবাদিক নুরুল ইসলাম হাসিব, নাদিম কাদির প্রমুখ।