সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ এর একটি এলাকার নাম ইরানি পাহাড়। ৬৭৯ একর আয়তনের এ পাহাড়ের আশপাশে এবং পাদদেশে অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের বসতি। মূল পাহাড়টি মূলত গহিন জঙ্গল, ঝোপঝাড়-গাছাপালায় আচ্ছাদিত। যেখানে সাধারণ মানুষের বিচরণ করা কঠিন। এ পাহাড়টিই অস্ত্রধারীদের নিরাপদ আস্তানা।

জানা যায়, উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় ইরানি পাহাড়ের আস্তানা থেকে। এর নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এ ছাড়া রয়েছে আরও ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই দুই সন্ত্রাসী সংগঠনের গোলাগুলিতে নিহত হন দু’জন।

এ পাহাড়ে শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে রয়েছে আরসার শূরা সদস্য ছমি উদ্দিন।

তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের। ছমি উদ্দিনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্যই পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একটি সংস্থা। তাদের তথ্যমতে, ইরানি পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় নাইন এমএম, এলএমজি, রিভলবার ও মেশিনগানের মতো ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু রাতে নয়, এখন দিনেও অস্ত্রের ঝনঝনানি। ক্যাম্পগুলোতে একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গেই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনাখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে রূপ নিয়েছে। এর প্রভাবে শুধু সাধারণ রোহিঙ্গাই নয়, পুরো কক্সবাজারের বাসিন্দারা এখন নিরাপত্তাঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছেন।

কোন ক্যাম্পে কে কে অস্ত্রধারীদের নেতৃত্বে রয়েছে তা সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ক্যাম্প-১ এর নেতৃত্বে রয়েছে মৌলভী আব্দুর রহমান, আব্দুর রহিম ও ইব্রাহিম। ক্যাম্প-২ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ মির্জা, শাকের, কলিম উল্লা, মাস্টার রফিক, দীন মোহাম্মদ, ছৈয়দ আলম ও মো. ইসমাইল।

ক্যাম্প-৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী হাসান, শাবিদ, হামিদ ওরফে হামজা ও আব্দুল হামিদ; ক্যাম্প-৪ এর নেতৃত্বে নবী হোসেন, মোহাম্মদ জুবায়ের ও আনিছ; ক্যাম্প-৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন হাফেজ আব্দুল্লাহ।

ক্যাম্প-৬ এর নেতৃত্বে কেফায়েত উল্লাহ ও মোহাম্মদ রফিক; ক্যাম্প-৭ এর নেতৃত্বে শফি উদ্দিন ও আব্দুল আলিম; ক্যাম্প-৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের।

ক্যাম্প-৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী ফজলুল কবির ও হাফেজ এহেসান; ক্যাম্প-১০ এর নেতৃত্বে সাঈদুল আলম ও সালাহ উদ্দিন প্রকাশ আবু জাদ্দুন; ক্যাম্প-১১ এর নেতৃত্বে হামিদ ওরফে শোয়াইব ও নুর কামাল; ক্যাম্প-১২ এর নেতৃত্বে আলী জোহার ও আতা উল্লাহ; ক্যাম্প-১৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী আবদুল হালিম ও মোহাম্মদ সোলতান; ক্যাম্প-১৪ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ, সাব্বির, রেজওয়ান, ওস্তাদ খালেদ ও নবী হোসেন; ক্যাম্প-১৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন আবুল কালাম ও আব্দুর রশিদ। ক্যাম্প-১৬ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ ইউনুস ও নুর মোহাম্মদ; ক্যাম্প-১৭ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ হাশিম ও ওস্তাদ খালেদ; ক্যাম্প-১৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ হাছন ও হাশিম।

ক্যাম্প-১৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী আনাস ও মৌলভী ইউনুস; ক্যাম্প-২০ এর নেতৃত্বে হারুন অর রশিদ, করিম উল্লাহ, আলী জোহার, মোহাম্মদ শাহ ও আব্দু শুক্কুর; ক্যাম্প-২১ এর নেতৃত্বে ওস্তাদ খালেদ ও শাহেদ এবং ক্যাম্প-২২ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ ইসলাম, জাবু ও কালাপুতু।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা মনে করেন, ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো মিয়ানমার থেকে আনা হচ্ছে। ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এসব অস্ত্র সরবরাহ করছে। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-১৪ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল বলেন, ‌পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প নজরদারিতে রয়েছে। এপিবিএন-৮ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে, গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় উদ্ধার হচ্ছে অস্ত্র।

জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত ছয় বছরে খুন হয়েছেন ১৮৯ রোহিঙ্গা। পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে ক্যাম্পগুলোতে ৫৫টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১৩১টি গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩১টি মামলাতে ৯৯১ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২০ জনের বেশি।

পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগের তুলনায় ক্যাম্পে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে ৮ হত্যা মামলায় আসামি ছিল ২২ জন, ২০১৮ সালে ১৫ মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ মামলায় আসামি ২৩৭ জন এবং চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৪০ হত্যা মামলায় আসামি রয়েছে ৪০৪ জন। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ক্যাম্পে ৪৪টি অপহরণ, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ২৩৮টি অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত এক হাজার

রোহিঙ্গাকে।

 

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *