নভেম্বর ১৪, ২০২৪

বাংলার মুক্তিকামী মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে থেকে ৫২ বছর আগে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, তা শুরুতেই ছিল একদিকে যুদ্ধে বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব। সেই নিঃস্ব-রিক্ত দেশ পুনর্গঠনের মহাযজ্ঞে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে উপকরণ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছিল কেবল অদম্য মনোবল ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। এই সঞ্চয়কে পুঁজি করে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান বা রূপরেখা তিনি প্রণয়ন করেছিলেন সেখানে সব নাগরিকের জন্য অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তি, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এসব লক্ষ্যের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের শুরুতেই লাখো ছিন্নমূল-ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ভূমি ও জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ সরবরাহ করে বঙ্গবন্ধু যে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন, তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক ও অগণতান্ত্রিক সরকারের দরিদ্রবিদ্বেষী নানা পদক্ষেপে কোণঠাসা লাখো প্রান্তিক মানুষকে আবারও আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূলধারায় আনতে বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের ২২ বছর পর ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এক উন্নয়ন দর্শনের সূচনা করেন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এই মডেলকে অনেকে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ বলেন। আমাদের দেশে কৃষি-ভূমি-জলাসংশ্লিষ্ট যত আইন ও বিধি আছে, তা নিয়ে নিবিড় এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ভূমিসংশ্লিষ্ট আইনগুলো একেবারেই পশ্চাৎপদ। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা উভয়ই দীর্ঘ সময় ধরে ঔপনিবেশিক নিয়মেই চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার যুগ যুগ ধরে চলা ভূমির বণ্টন ও মালিকানা নিয়ে অসমতা দূর করতে নির্মোহ কিছুু উদ্যোগ নিয়েছিল। ধনী ভূস্বামী এবং স্বার্থপর ও লোভী মানুষের জোটবদ্ধ প্রয়াস বঙ্গবন্ধুর সেসব উদ্যোগকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছিল।
যার ফলে জমিতে যাদের ন্যায্য হিস্যা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভূমিহীন হয়েছে। দীর্ঘ অনিয়মের যাত্রায় এখনো প্রকৃত কৃষিজীবী, জলাজীবী, বনজীবীরা অনেকটাই ভূমিহীন, এমনকি জমিতে তাদের অভিগম্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। এই অবস্থা নিরসনে কোনো সরকার ও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের সুচিন্তিত ও কার্যকর কোনো পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দীর্ঘদিন আমাদের চোখে পড়েনি। যাতে করে বোঝা যায় যে, আসলে রাষ্ট্র তার নাগরিক, যারা ভূমিহীন তাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ১৯৯৭ সালে দেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গৃহীত ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামের একটি বৃহৎ কর্মসূচি। এর মাধ্যমে তিনি এ দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বদলে দেওয়ার জন্য নতুন এক উন্নয়ন দর্শনের সূচনা করেন, যেটি ‘দারিদ্র্য বিমোচনে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন : ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়- ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা। এই কর্মসূচি চলমান রাখতে বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটির তত্ত্বাবধানে চলমান যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে, সেই পথে ব্যত্যয়-বিঘœ-সমস্যা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে হয়তো কয়েক প্রস্থ লেখাজোখা করা সম্ভব। দেশের অসঙ্গতি ও মূল্যবোধ বিনষ্টের দীর্ঘ অপসংস্কৃতি ও ধারায় এটাই স্বাভাবিক। তবে এই উদ্যোগের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব নিয়ে ব্যক্তি শেখ হাসিনার চরম বিরোধী পক্ষও নিশ্চয়ই কোনো প্রশ্ন করবে না, যদি না তিনি মানসিক বৈকল্যের শিকার হন।

কেননা, জ্ঞানচর্চা একটি নির্লোভ-নির্মোহ প্রক্রিয়া। এখানে পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে নতুন তথ্য, নতুন বিশ্লেষণ, নতুন চর্চা ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই সুস্থ চর্চা। এই জ্ঞানচর্চার ফল তাৎক্ষণিভাবে কে কে পেল, কি করে পেল সেটি বিবেচনা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শন করে নদীভাঙনে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন কিছু ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় পরিবারকে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিহীনদের জন্য সেটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও সত্যিকার সদিচ্ছা, কার্যকর নীতির অভাব আর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর যোগসাজশে সেসব উদ্যোগ প্রকৃত অর্থে ভূমিহীন ও প্রান্তিক মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। বরং এসব উদ্যোগকে পুঁজি করে একদিকে নতুন নতুন ভূমিসংক্রান্ত সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ আরও দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে।

অন্যদিকে, মন্ত্রী-এমপি-আমলা-বিত্তবানদের জন্য রাষ্ট্রের অতিমূল্যবান ভূমিতে বড় বড় প্লট-ফ্ল্যাট-ভবন বরাদ্দ হয়েছে। সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এর মূল কারণ। দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করার মতো অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেসব নিয়ে পত্রপত্রিকা ও টিভি টক শোতে নিত্যদিনই আলোচনা হয়। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার জন্মবার্ষিকীতে সেই সমালোচনায় যোগ দিতে চাই না। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, অতীতে ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ও লাখো ভূমিহীন মানুষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি জমি-ভূমি-আবাসন বরাদ্দের যে ‘মচ্ছব’ শুরু হয়েছিল তা শেখ হাসিনার আমলে কমেছে।

পক্ষান্তরে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোকে উন্নয়নের মূলধারায় আনতে জলবায়ু উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিক্ষুক, বেদে, দলিত, হরিজনসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য জমিসহ ঘর প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, নারীদের জমিসহ ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন করা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন করা, ব্যাপকহারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন করা এবং গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে দুই শ্রেণিতে দেশের ‘সকল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবার’ এবং ‘সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই এমন পরিবার’ নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পথরেখা ধরে সবদিক দিয়েই দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।

১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সূচনা করে এ পর্যন্ত ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর এবং মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। যদি ধরে নিই, ৪ সদস্যের একটি পরিবার আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছে, তাহলে বলা যায় যে ‘ভূমিহীন মানুষ’-এর মতো বেদনাদায়ক উপাধি সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন প্রায় ২০-২১ লাখ মানুষ। তালিকাভুক্ত সকল পরিবারই পর্যায়ক্রমে এই কর্মসূচির আওতায় আসছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি কেবল আবাসনের ও ভূমির ব্যবস্থা নয়, বড় পর্দায় দেখলে বলা যায়, এটির পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত।

দেশের ভূমি সংস্কার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। উপকারভোগীরা দুই শতাংশ করে জমি পেয়েছেন, একটি অর্ধপাকা দুই কক্ষের ঘর পাচ্ছেন, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন। সরকারিভাবে করে দেওয়া গৃহে আধুনিক গোসলখানা, টয়লেট ও রান্নাঘর আছে। গৃহসহ জমি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথভাবে দলিল করে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো হচ্ছে। প্রতি ১০টি পরিবারের সুপেয় পানির জন্য থাকছে নলকূপ। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন সুবিধাভোগীরা। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের শরীর গঠন ও বিনোদনের জন্য থাকছে খেলার মাঠসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা।
একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রামের সব নাগরিক সুবিধাই থাকছে আশ্রয়ণ নামের এই প্রকল্পে। এ ছাড়াও উপকারভোগীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পেশামুখী প্রশিক্ষণ। বিশেষ করে ব্যারাকে বসবাসকারী সুবিধাভোগীদের মৎস্য চাষ, পাটি বুনন, নার্সারি, নকশীকাঁথা, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক ওয়ারিং এবং রিক্সা-সাইকেল-ভ্যান গাড়ি মেরামতের মতো ৩২টি পেশায় প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।

প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের আয়-রোজগারের যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পরে উপকারভোগীদের জন্য সমবায় সমিতি গঠন করে আয় বৃদ্ধিকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। ভিজিএফের আওতায় ব্যারাকে পুনর্বাসিত পরিবারগুলো প্রাথমিকভাবে তিন মাসের খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন। মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, বিধবা এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় ভাতা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তারা। অর্থাৎ, একজন নিঃস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজনীয় মোটামুটি সবকিছুই রাষ্ট্র দিতে উদ্যোগী হয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে, এখানেই রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ব্যক্তি শেখ হাসিনার জীবনের সার্থকতা।

লেখক: ড. মো. আইনুল ইসলাম
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...