জনরোষের মুখে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই সেখানে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংঘটিত এই প্রতিবাদ, যাকে কখনো কখনো ‘মৌসুমি বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়, সেই আন্দোলনে হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে প্রাণ দিতে হয় হাজারো বাংলাদেশিকে আর আহত হয় অসংখ্য মানুষ।
এখন বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের প্রায় ১৬ বছরের দুঃশাসনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে দেশ পুনর্গঠনে কাজ চলছে। এই কাজে অর্থের জোগান পাওয়াটা ভীষণ আবশ্যক হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর এই অর্থের চাহিদার মধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণগ্রহণ এবং তা পরিশোধ না করার মতো বিষয়গুলো।
বাংলাদেশের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ক্ষমতাশালী পরিবার ও ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন এবং তা হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে বাইরে পাচার করেছেন। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার প্রভাবশালী বলয়ের মধ্যে থাকা সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিপুল সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে দেশটিতে। যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে তাদের বিনিয়োগ করা এসব সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নামে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল অট্টালিকা পর্যন্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও দেশটির বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (অফশোর কোম্পানি) নামে এই সম্পত্তির অনেকগুলো কেনা হয়েছে। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা ওই সম্পত্তির অনেকগুলোর মালিকানায় রয়েছেন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন তার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও অনেক সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে।
সালমানের পরিবারের সদস্যদের লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার গ্রোসভেনর স্কয়ারে সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা বা মালিকানায় অংশীদারত্ব রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চ মাসে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান। সেখানে ৩ কোটি ৫৫ লাখ পাউন্ডে কেনা তার একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। গ্রোসভেনর স্কয়ারে এবং এর কাছাকাছি এই পরিবারের আরেক সদস্য আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের আরও চারটি সম্পত্তি রয়েছে। এর মূল্য ২ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে এসব সম্পত্তি কেনা হয়।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের ৩০০টির বেশি সম্পত্তি রয়েছে। এগুলোর মূল্য অন্তত ১৬ কোটি পাউন্ড। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বৈশ্বিক সম্পত্তি নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশে থাকা তার সম্পত্তির মূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার।
রাজনীতিকদের বাইরে বাংলাদেশের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদেরও যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সারে এলাকায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যদের দুটি সম্পত্তি রয়েছে। ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে।
গত ২১ অক্টোবর আহমেদ আকবর সোবহানসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যের ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ ছাড়া তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে সাফওয়ান সোবহান। তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে তার পরিবার।
অন্যদিকে, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে সিআইডি। বাংলাদেশ তার সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। লন্ডনের কেনসিংটনে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা কীভাবে ৩ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের পাঁচটি সম্পত্তি কিনেছেন তা খতিয়ে দেখতে চায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ উপায়ে এসব সম্পত্তি কেনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পলিসি ডাইরেক্টর ডানকান হামেস বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের উচিত বিশ্বব্যাপী মিত্রদের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা যাতে সন্দেহজনক সম্পদ জব্দসহ নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থা চালু করা যায়। আর বিশ্বের দুর্নীতিবিরোধী রাজধানী হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন সরকারের জন্য তা হোক উচ্চাভিলাষী প্রথম পরীক্ষা।’