বাবা আদম মসজিদ মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপালের অন্তর্গত রিকাবিবাজার ইউনিয়নের কাজী কসবা গ্রামে অবস্থিত। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরোলেই বাবা আদম মসজিদ। আর ঢাকা থেকে সড়কপথে মসজিদের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। এই মসজিদের সম্মুখভাগে কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের শীর্ষে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদের নির্মাণ তারিখ ৮৮৮ হিজরি, ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দ। সুলতান ফতেহ শাহের শাসনকালে মালিক কাফুর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। বাবা আদমের মসজিদের কাছে মসজিদ প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নবনির্মিত একটি ক্ষুদ্র কবর আছে। কবরটি বাবা আদম শহীদের মাজার বলে পরিচিত। পূর্বে কবরের উপরে কোনো আচ্ছাদন ছিল না। বর্তমান মাজারটি বর্গাকৃতির (৭.৬২ মিটার একক বাহু), তারিখবিহীন এবং এতে কোনো শিলালিপি নেই।
মসজিদটি বহু গম্বুজবিশিষ্ট এবং ভূমি পরিকল্পনায় আয়তাকৃতির। এ মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের পরিমাপ ১০.৩৫ মিটার ´ ৬.৭৫ মিটার এবং বহির্ভাগের পরিমাপ ১৪.৩০ মিটার ´ ১১.৪৫ মিটার। মসজিদটির দেয়াল ২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে তিনটি ‘বে’ ও দু’টি ‘আইল’ আছে।
মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালের পশ্চাৎভাগ বাইরের দিকে তিন স্তরে বর্ধিত। পেছনের বর্ধিতাংশটি খুবই সুন্দর। বাবা আদমের মসজিদটি ছয়টি সমাকৃতির অনতিউচ্চ গম্বুজে আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলো পর্যায়ক্রমে দুই সারিতে স্থাপিত। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে দু’টি দণ্ডায়মান কালো ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভ। এগুলো প্রাক-মুসলিম যুগের ভগ্ন অথবা পরিত্যক্ত ইমারতের স্তম্ভ বলে প্রতীয়মান হয়। মসজিদটিতে বাংলায় সুলতানি শাসন আমলে বিকশিত স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও অলঙ্করণশৈলী প্রকাশ পেয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশে মসজিদ স্থাপত্যে সুলতানি স্থাপত্যরীতি পরিণত রূপ লাভ করেছে বাবা আদমের মসজিদে।
তথ্য মতে, প্রায় ৫৩৪ বছরের পুরনো বাবা আদম মসজিদ। সুদূর আরব দেশে জন্মগ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম রহ:। উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্বে। ওই বছরই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে। এ বিষয়ে নানা কল্পকথা ও স্থানীয় জনশ্রুতি রয়েছে। শাহ হুমায়ুন কবির The Battle of Kanai Changue গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাবা আদম শহীদ রহ: আরবের তায়েফ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন। বাবা আদম শহীদ রহ: ১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন। সেখান থেকে ১১৫২ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে আসেন। মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন।’
শহীদ বাবা আদমকে মীরকাদিমের দরগাবাড়ীতে দাফনের পর তার কবরের পাশে ১৪৮৩ সালে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এটি ছিল তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে ৩৬ ফুট। মসজিদে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট। মসজিদটির দেয়াল আট ফুট চওড়া। ছাদ বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ ঢালু রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজাও রয়েছে। মসজিদটি নির্মাণের সময় লাল পোড়ামাটির ১০ ইঞ্চি, সাত ইঞ্চি, ছয় ইঞ্চি ও পাঁচ ইঞ্চি মাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের ভেতরে দু’টি স্তম্ভ রয়েছে।
এটি ১৯৪৮ সাল থেকে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯১-৯৬ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাবা আদম মসজিদের ছবিসংবলিত ডাকটিকিট প্রকাশ করে। কারুকার্যখচিত এ মসজিদ নির্মাণে সময় লেগেছিল চার বছর। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে মাঝখানের দরজার ঠিক উপরে একটি আরবি শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন ব্লকম্যান।
৫৩৫ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যের চোখ জুড়ানো এই শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযতœ-অবহেলার ছাপ। ভারতবর্ষ প্রতœতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় সেভাবেই ফেলে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের দিকে এর চারপাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়। ব্যস, এ পর্যন্তই।
কিভাবে যাওয়া যায় : ঢাকার পাশের জেলা মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপালে হজরত বাবা আদম শহীদের রহ: মাজারসংলগ্ন মসজিদ অবস্থিত। সড়কপথে ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। তবে এই মাজারে আসার জন্য আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে আসতে হবে। ঢাকা হতে সকালে এসে মাজার জিয়ারত ও মসজিদ দর্শন করে বিকেলেই ঢাকায় ফিরে আসা যাবে। সড়কপথে যেতে কষ্ট হবে না। তবে নৌপথে গেলে সময়ও বাঁচবে এবং যানজট এড়িয়ে নদীপথের সৌন্দর্য অবগাহন করে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পৌঁছানো যাবে। সদরঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চে ২ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে রিকশায় দরগাবাড়ী হজরত বাবা আদম শহীদের রহ: মাজারসংলগ্ন মসজিদে যাওয়া যায়। ভাড়া ২৫-৩০ টাকা।
বাবা আদমের মসজিদ ও মাজার বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রামপাল গ্রামের কাছে কাজী কসবা গ্রামে সুলতানি আমলের একটি ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ আছে। এর গজ কয়েক পূর্বে আছে একটি মাজার। মাজারটি ২৫ ফুট বাহুবিশিষ্ট বর্গাকার আয়তনের ইটের তৈরি মঞ্চের ওপর একটি পাকা সমাধি বিশেষ। মসজিদটি আয়তাকার ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। উত্তর-দক্ষিণে এর আয়তন ৪৩ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩৬ ফুট। চার কোণায় চারটি অষ্ট কোণাকৃতির বুরুজ বা মিনার। মিনার ছাদের কার্নিশের উপর উঠেনি। মিনারের ধাপে ধাপে মনোরম বলয়াকারের স্ফীত রেখায় অলঙ্করণের কাজ আছে। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার অবতল মেহরাব।
কেন্দ্রীয় মেহরাবের পেছন দিকের দেয়াল বাইরের দিকে উদগত। সামনের দেয়ালের ধনুকাকৃতির খিলানবিশিষ্ট তিনটি প্রবেশ পথে আয়তাকারে নির্মিত যেসব ফ্রেম আছে তার শীর্ষ দেশে অতি সুন্দর কারুকাজ আছে। প্রধান প্রবেশপথের দুই পাশে গভীর সমতল কুলুঙ্গী। উপরি ভাগ সুন্দরভাবে খাঁজকাটা। ঝুলন্ত শিকল ও ঘণ্টার অলঙ্করণ রয়েছে। মসজিদে কোনো বারান্দা নেই। অভ্যন্তর ভাগে আছে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত দু’টি স্তম্ভ। অভ্যন্তর ভাগ এই দু’টি স্তম্ভের সাহায্যে পূর্ব-পশ্চিমে দুই সারিতে এবং উত্তর-দক্ষিণে তিন সারিতে বিভক্ত। স্তম্ভ দু’টি মাঝ থেকে চার ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকৃতির এবং এরপর ষোলকোণাকৃতির। এই দু’টি স্তম্ভ এবং চারপাশের দেয়ালের উপর মসজিদের অর্ধবৃত্তাকার ছোট ছোট গম্বুজ ছয়টি স্থাপিত। গম্বুজ ও মসজিদের অভ্যন্তর-ভাগের মতোই পূর্ব-পশ্চিমে দুই এবং উত্তর-দক্ষিণে তিন সারিতে বিভক্ত। দেয়াল অতিশয় পুরু। প্রধান মেহরাবটি এবং দুই পাশের দুই মেহরাব ও পাশের দেয়াল লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা ও গোলাপফুল, ঝুলন্ত প্রদীপ ও শিকল প্রভৃতি অত্যন্ত সুন্দর পোড়ামাটির চিত্র ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত। মসজিদের বাইরের দিক বিশেষ করে সামনের দেয়াল অতি সুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের দুই পাশে কিছু কিছু চিত্রফলকের কাজ এখনো চোখে পড়ে।