ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষারত ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে ছবি তোলার অনুরোধ করতেই রাজী হয়ে গেলেন। খুব কাছে গিয়ে তাকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের স্মৃতি মনে আছে কিনা জানতে চাইলে বললেন, ‘মনে থাকবে না কেন…ওই টুর্নামেন্টে ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়, সংগঠক, কোচ, সাংবাদিক সবাই একসঙ্গে থাকে।’
মরগ্যান চার বছর আগে লর্ডসে উচিঁয়ে ধরেছিলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। অবসরে যাওয়া এই ইংলিশ ক্রিকেটারকে এবার আইসিসি যুক্ত করেছে ধারাভাষ্যকার হিসেবে। আজকের ডে অফ দিনে তাকে আইসিসি ব্যস্ত রাখলো ওপেন মিডিয়া সেশনে। যেখানে ইংলিশ গণমাধ্যমের সঙ্গে বাংলাদেশি সাংবাদিকরাও থাকার সুযোগ পেলেন।
সংবাদ সম্মেলন কক্ষের পরিবর্তে ধর্মশালা স্টেডিয়ামের পিঙ্ক গ্যালারিতে মরগ্যানের সামনে একগাদা ক্যামেরা ও রেকর্ডার। ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের ম্যাচের আগে মরগ্যান গণমাধ্যমের জন্য বাড়তি পাওয়া। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়া বরাবরের মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাই অনেকটা জোর করে, উচুঁ গলায় বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা প্রশ্নের পথ খুঁজে নেন।
যেখানে ঘুরে ফিরে ২০১৫ সালের অ্যাডিলেড হার প্রসঙ্গও উঠে আসে। কিন্তু এদিন মরগ্যান ভিন্ন চেহারায়। ইংলিশ মিডিয়াও চনমনে। প্রশ্নটা শুনে মরগ্যানই শুধু হাসলেন না, ইংলিশ মিডিয়াও হাসিতে ফেটে পড়ল।
‘২০১৫ বিশ্বকাপের হার নিশ্চয়ই মনে আছে। অ্যাডিলেডে! আপনি ওই ম্যাচের হাইলাইটস কতবার দেখেছেন। দেখে থাকলে প্রতিক্রিয়া কি হয়?’ এমন প্রশ্নে বাংলাদেশি সাংবাদিক ইংল্যান্ড ক্রিকেটের অভিশপ্ত দিনটিকেই মনে করালেন ধর্মশালার সুন্দরতম মাঠে। যেখানে মন প্রশান্তি পায়। আনন্দে ভরে উঠে। মরগ্যান বেশি গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না, ‘আমি কখনোই হাইলাইটস দেখিনি। কিন্তু সবসময়ই প্রসঙ্গটি উঠে আসে। বিশেষ করে, নাসের হুসেইন সবসময়ই এটি মনে করিয়ে দেয়। নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন তাই পড়ে না আমার।’দ
বাংলাদেশের প্রশংসা করে সাবেক অধিনায়ক যোগ করেন, ‘তবে হ্যাঁ, ওরা কঠিন প্রতিপক্ষ। ওদের সঙ্গে খেলা সহজ নয়। ২০১৫ সালে সম্ভবত ওদের পেস বোলিংয়ে অভিজ্ঞতা একটু বেশি ছিল। এবার তা নেই, তবে প্রতিভা দিয়ে অভিজ্ঞতার ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়া যায়। ওরা ভালো দল। অ্যাডিলেডে ওই ম্যাচে ওরা আমাদের চেয়ে ভালো দল ছিল।’
পরপর দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ হেরে শূন্য হাতে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। ২০১১ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ সালেও একই পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি। সেই রাতে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ড দলের ওপর বয়ে গিয়েছিল টর্নেডো! যে হার ইংল্যান্ডের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর নতুন ভোরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ইংলিশরা, মিশন ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৯। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ, যেকোনো মূল্যে শিরোপা জিততেই হবে। লর্ডসের ব্যালকনিতে উঁচিয়ে ধরতে হবে সোনালী ট্রফিটি।
যেমন কথা তেমন কাজ। চার বছরের রোডম্যাপ তৈরি করে ইসিবি। নেওয়া হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। শুরু হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। অধিনায়ক মরগ্যানকে দেওয়া হয় পূর্ণ স্বাধীনতা। খেলোয়াড়রাও হয়ে উঠেন প্রাণবন্ত, উদ্যমী।
২০১৫ থেকে ২০১৯। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড। অ্যাডিলেড থেকে লর্ডস। মাঝে ১০ হাজার মাইলের দূরত্ব। চার বছরে দিনের ব্যবধান ১ হাজার ৫৮৮। সময়ের ব্যবধান ৩৮ হাজার ১১২ ঘণ্টা। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল শেষমেশ ভোগ করতে পারে ইংল্যান্ড। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ‘ক্রিকেটের জনক’ ইংল্যান্ডের ঘরে যায় অরাধ্য সেই সোনালী ট্রফি। মরগ্যানদের স্বপ্নপূরণ।
সেই শিরোপা এবারও ধরে রাখতে চায় ইংল্যান্ড। কিন্তু ভারত বিশ্বকাপে তাদের শুরুটা হয়েছে একদম বাজে। নিউ জিল্যান্ডের কাছে হারের পর মঙ্গলবার দ্বিতীয় ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। যারা প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে উড়িয়েছে ৬ উইকেটের জয়ে। ইংল্যান্ডের পেসাররা এই কন্ডিশনে বাংলাদেশকে বড় চ্যালেঞ্জ জানাবে বলেই বিশ্বাস মরগ্যানের।
“ওরা খুবই ‘ট্রিকি’ প্রতিপক্ষ, খেলা যেখানেই হোক না কেন। এখানে অবশ্য কন্ডিশন বাংলাদেশের চেয়ে ইংল্যান্ডের জন্যই সহায়ক হবে। আগের ম্যাচে দেখেছি, কিছুটা বাউন্স ছিল এখানে। গতিময় বাউন্স নয়, তবে বাড়তি বাউন্স ছিল। ইংল্যান্ডের সিমাররা এখানে বাংলাদেশকে লড়াইয়ের বাইরে ছিটকে দিতে পারে।”
বাংলাদেশের ম্যাচ উইনার এখন বেশি। এ নিয়ে বেশ খুশি মরগ্যান। তরুণরা দায়িত্ব নেওয়ায় অভিজ্ঞরা চাপহীন খেলতে পারছে বলে বাংলাদেশ সীমিত পরিসরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি, ‘অতীতে তাকিয়ে যদি দেখেন, যখন তারা ম্যাচ জিতেছে, মূলত তাদের বড় নামগুলোর ওপরই নির্ভর করেছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়টাতে ইতিবাচক দিক হলো, শান্ত-মিরাজের মতো তরুণরা চাপটাকে সরিয়ে দিতে পেরেছে। সাধারণত যে কাজটা আগে তাদের অভিজ্ঞরা করত। গতকালকের ম্যাচে যদি দেখেন, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের অভিজ্ঞরা সব চাপ সয়ে দলকে এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তরুণরা যা করেছে, তা যদি করে যেতে পারে, তাহলে তা সাকিবের পারফরম্যান্স ও নেতৃত্বের জন্য সহায়ক হবে।’
সীমিত পরিসরে ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশও ভালো ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু বড় কোনো শিরোপা ধরা দেয়নি বাংলাদেশের। ইংল্যান্ড যে নিবেদন দেখিয়েছে, পরিশ্রম করেছে তা ছিল অবিশ্বাস্য। অভিজ্ঞদের সঙ্গে তরুণদের দারুণ রসায়নে ধরা দেয় বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফির। বাংলাদেশ কিভাবে জিততে পারে বড় শিরোপা? সেই রেসিপিও জানিয়ে দিলেন ধর্মশালায়।
মরগ্যানের উপদেশ, ‘এটা অবশ্যই বড় এক চ্যালেঞ্জ। প্রতিভা ওদের যথেষ্টই আছে। তবে সেই প্রতিভা কীভাবে ব্যবহার করা যায় ও শাণিত করা যায়, তার ওপরই নির্ভর করবে বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে কতটা লড়াই করতে পারবে। ভবিষ্যতে তারা কোন পথে এগোবে, সেটিকে শনাক্ত করে, ভবিষ্যতে দলের চেহারা কেমন হবে, সেটাকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দিয়ে, সেভাবেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এটা হয়তো তাদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে এবং তাদের পক্ষে কাজ করতে পারে।’
হাসিখুশি মরগ্যান ইংল্যান্ডের জয়ের অপেক্ষায়। ধর্মশালায় ইংলিশরা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে এমনটাই তার চাওয়া। তার এই চাওয়া কি সাকিব, মুশফিক, তাসকিনরা এলোমেলো করে দিতে পারবেন? তাহলে ধারাভাষ্য কক্ষে বসে নিশ্চয়ই আরেকটি বাজে দিন কাটাতে হবে চার বছর আগের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ককে।