নভেম্বর ২৬, ২০২৪

ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। ভোটের পরিবেশেরও প্রশংসা করেছেন তারা। একইসঙ্গে ভোটের পদ্ধতিকে অন্যদেশের জন্য অনুসরনীয় বলেও অ্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁরা। রবিবার ভোটের পর্যবেক্ষণ প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা এই প্রশংসা করেন।
ভোট পর্যবেক্ষণ শেষে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। তারা ভোটের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ভোটদান প্রক্রিয়া ও পরিবেশের প্রশংসা করেন।

সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে ফিলিস্তিনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাশিম কুহাইল বলেছেন, আমরা বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। ভোট শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, এছাড়া ভোটের পরিবেশও খুব ভালো ছিল। নাগরিকদের ভোটদান প্রক্রিয়াও খুব সহজ ছিল। এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যেই ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিবিদ জিম ব্যাটস প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ভোট সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করেছে।

ব্রিফিংয়ে কানাডার এমপি চন্দ্রকান্থ আরিয়া ও ভিক্টর হো বক্তব্য রাখেন। চন্দ্রকান্থ আরিয়া বলেন, সুষ্ঠু ভাবে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। ভোটে রেকর্ড নাম্বার নারী ভোটার উপস্থিতি ছিলেন । আমরা ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনো কেন্দ্রে ভিজিটের সুযোগ পেয়েছি। সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানাই।

এক প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্রকান্থ আরিয়া বলেন, যারা ভোট বয়কট করেছে, সেটা তাদের বিষয়, এটা আমাদের বিষয় না। কানাডায়ও ভোট ৪৩ শতাংশ পড়েছিলো, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। জনগণ ভোট দিতে পারছে কি না, এটাই দেখার বিষয়। নাইজেরিয়ার সিনেটর প্যাট্রিক সি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। স্থানীয়দের উৎসাহের সঙ্গে ভোট দিতে দেখেছি। শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাশিয়ার নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান আন্দ্রেই শুতভ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। আমরা এখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। বিভিন্ন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণের পর আমার অনুভূতির কথা জানাতে চাচ্ছি। খুবই উন্নত মান বজায় রেখে নির্বাচনে সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। নির্বাচনের তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও স্বচ্ছতার বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল।

বাংলাদেশে নির্বাচনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে রাশিয়ার নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান বলেন, নির্বাচনের দীর্ঘ ইতিহাসের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া স্থিতিশীলভাবে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি রয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চায় না, তিনি তার মাধ্যমে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিয়ার এই পর্যবেক্ষক বলেন, এক মেরুর বিশ্ব থেকে বের হয়ে আমরা একটি বহু মেরুর বিশ্বের দিকে যাওয়ার ক্রান্তিকালে রয়েছি। অর্থাৎ, বিশ্বের কেবল একটি দেশের আধিপত্য আর থাকছে না, বিশ্বে আরও বহু মেরুকরণ হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাই আমরা দেশটিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকালে একজন প্রার্থীকে আমি সেই কথাই বলেছি।

গাম্বিয়ার পর্যবেক্ষক দল বলেছেন, এবারের নির্বাচন, উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক ছিলো। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখনও রুপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একে সময় দেয়া উচিৎ। যারা বাংলাদেশকে স্থিতিশীল দেখতে চায় না। তারাই, এদেশের নির্বাচন নিয়ে নানান সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা করে। স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশে নিজের মন মত চলবার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বমানের ভোটকেন্দ্রে বাংলাদেশের মতো ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য জিনিস ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেই কারণে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ গর্ব করতেই পারে। গুড ভোটিং প্রসেস ইন ভোটিং ডে। ভোট কাস্টিং এটি একটি ভালো নির্বাচন বলতে চাইছেন, পর্যবেক্ষকরা।
ওআইসির নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও ওআইসির নির্বাচন ইউনিটের প্রধান শেখ মোহাম্মদ বন্দর। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের কার্যক্রম দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। রবিবার বিকেলে ভোটগ্রহণের সময় শেষে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তারা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেন, ভোটার এবং প্রার্থীর এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে তারা সন্তুষ্ট। ওআইসির নির্বাচন ইউনিটের প্রধান শেখ মোহাম্মদ বন্দর বলেন, পর্যবেক্ষক হিসেবে সহিংসতার কোনো চিহ্ন আমাদের চোখে পড়েনি। আমি অবাক হয়েছি, দোকান-পাট বন্ধ কেন! সড়কে কোনো মানুষ দেখা যায়নি। শহর ছিল শান্ত।’ তাকে করা নানা প্রশ্ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আপনি এমন একটি দেশ থেকে এসেছেন যেখানে যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে আসা কি গুরুত্বপূর্ণ? বাংলাদেশে আসার জন্য আপনার ওপর কোনো ধরনের চাপ ছিল? বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ ছিল কি না?’
এসব প্রশ্নের জবাব ‘না’ জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তিন মাস আগে আমি যখন জিম্বাবুয়েতে ছিলাম, তখন আমন্ত্রণপত্র পাই। আমি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর থেকে এসেছি, গাজার মতো সেখানে যুদ্ধ চলছে না।

আরব ইলেকট্রোরাল ম্যানেজমেন্ট বডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার দেশের পাশাপাশি আমি ওই সংগঠনেও প্রতিবেদন জমা দেবো। যে কারণে এই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অভিজ্ঞতা বিনিময়। আপনাদের অভিজ্ঞতা এবং আমি ও বাংলাদেশে আমার সহকর্মীরা আজ যা দেখলাম, এই সফরে আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখলাম। এটা একটি পেশাগত সফর ছিল।’
নির্বাচনী পরিবেশ দেখে সন্তুষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ভালো নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখেছি। কম ভোটার উপস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখনো জানি না কত শতাংশ ভোট পড়েছে। সকালে যখন আমরা কেন্দ্র পরিদর্শন করি, তখন ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। মানুষ আশা করছিল উপস্থিতি বাড়বে। যদি বাধ্যবাধকতা না থাকে, আপনি কেন্দ্রে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং কেউ আপনাকে ভোট দিতে বাধ্য করতে পারে না। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের দেশে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, ‘১৫ বা ১৬ শতাংশ ভোট পড়লে সেটা নির্বাচন আয়োজকদের জন্য বার্তা। এর কারণ রাজনীতিকরা বিশ্লেষণ করবেন। আমি জর্ডানে অনেক নির্বাচন দেখেছি, সেখানে ৫৫ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং সেটা ভালো নির্বাচন ছিল। তারপরও এই বিষয়টা দেখবেন রাজনীতিক ও গবেষণা সংস্থাগুলো।

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্য মার্টিন ডে বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও বাংলাদেশে ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। অন্তত ভোটের দিনের পরিস্থিতি শান্ত ও উৎসবমুখর ছিল। তবে বড় একটি দল ও জোটের অংশগ্রহণ না থাকায় নির্বাচনটি একেবারে নিখুঁত হয়েছে বলা যাবে না। আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে নির্বাচনটি আরও আকর্ষণীয় হতো।

সাউথ এশিয়ার ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, বাংলাদেশে এবারের ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরনীয় হয়ে থাকবে। ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে নারী ও যুবকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। নারীদের অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে ভোট দিতে দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ছিল খুবই শান্তিপ্রিয় ও প্রাণবন্ত। পর্তুগালের সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, সংসদীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুই প্রার্থীর এজেন্টরা একই টেন্টে বসে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে এটি অবশ্যই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতেও নির্বাচনগুলোতে এভাবে পরিবেশ থাকা উচিত।

একটি বড় দল নির্বাচন বয়কট করছে সেই পরিস্থিতিতে কিভাবে অনুসরনীয় নির্বাচন বলা হয়েছে এক সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতিতে কোন দলের নির্বাচনে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত সময়ে নির্বাচনের দাবিতে গাড়িতে ও ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মারার ঘটনা ঘটেছে। বিগত ২০১০ সালে শত শত মানুষকে আগুনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পরেও মানুষকে পুড়িয়ে মারা ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু বিগত সময়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন ব্যতিক্রম। গণতান্ত্রিক দেশে অবশ্যই সব দলকে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া উচিত।

পর্তুগালের সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেছে যেটি সংবিধানে নেই। পাকিস্তানেও বিগত ১৯৮৫ সালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তা আর টেকেনি। আর বাংলাদেশেও বিগত ২০০৭-০৮ সালে তত্ত¦াবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে এটি বাতিল হয়েছে। তাই কোন দলকে পরিবর্তন আনতে হলে নির্বাচনে অংশ নিয়েই আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আরব পার্লামেন্ট সদস্য আবদিহাকিম মোয়ালিয়াম আহমেদ বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক চর্চায় ইতিহাস গড়েছে। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটারদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...