টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও শিল্পায়নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে শিল্পায়ন পরিকল্পনায় পানি, বায়ু, বন-বাস্তুসংস্থানসহ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সংগঠনের ব্যবসায়ী নেতা ও শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের কর্ণধাররা।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আরণ্যক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ন্যাচারাল রিসোর্সেস কনজারভেশন: স্কোপ অব প্রাইভেট সেক্টর এনগেজমেন্ট’ শীর্ষক কর্মশালায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। কর্মশালায় পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে সরকারি প্রণোদনা প্রদান জরুরি বলে মত দেয়া হয়। এছাড়া পরিবেশবান্ধব কারখানায় তৈরি পোশাকের বাড়তি দাম দেয়ার জন্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
আরণ্যক ফাউন্ডেশন বাস্তবায়িত ইউএসএআইডির গ্রিন লাইফ প্রকল্পের আওতায় এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশের ইকোনমিক গ্রোথ অফিসের পরিচালক ড. মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘১৯৯০ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় ইউএসআইডি কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের বিকাশের ফলেই বাংলাদেশের বিদেশী সাহায্যনির্ভরতা কমেছে। কর্মশালায় উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ও মতামত দেশের জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পানি, বায়ু ও মাটি দূষণের কেন্দ্রে বনের অবক্ষয়। বন সংরক্ষণ করতে পারলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের অনেক সংকটের সমাধান মিলবে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি খাতের সক্রিয় উদ্যোগ আশা করছি।’
এর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিকেএমইএ ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক জানান, পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপন করে তিনি সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু ব্যবসার মুনাফার ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, যা ব্যবসাকে কঠিন করে তুলেছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে উদ্যোক্তাদের আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার দাবি তার। একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাড়তি দাম দেয়ার ব্যাপারে ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজীম। তিনি জানান, বর্তমানে পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাকের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে পছন্দের বাজার। বর্তমানে দেশে ১৯৫টি লিড সনদধারী পোশাক কারখানা রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা দেশের প্রত্যেকের দায়িত্ব। পরবর্তী প্রজন্মকে একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবী উপহার দিতে বিজিএমইএ ফোর আর বা রিইউজ, রিডিউস, রিসাইকেল, রিকভার ধারণা বাস্তবায়ন ও তাপ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে।
গেস্ট অব অনারের বক্তব্যের বিএসআরএমের হেড অব ব্র্যান্ডিং ফারাহ শাহরুখ রাজা জানান, তার প্রতিষ্ঠান পরিবেশের কথা চিন্তা করে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার নকশা করেছেন। তারই অংশ হিসেবে বর্জ্যকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। এর আগে স্বাগত বক্তব্যে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নে পরিবেশ ও ব্যবসায়িক মুনাফা চর্চার মধ্যে সমন্বয় আনা জরুরি। দূষণ বন্ধে নতুন নতুন ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাস্তুসংস্থান সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে জলবায়ু সংকটের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’
কর্মশালার সমাপনী বক্তব্যে ইউএসএআইডির ইকোনমিক গ্রোথ অফিসের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ শাহাদাত হোসাইন শাকিল জানান, তাপমাত্রা বাড়লে কিংবা উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্লাবিত হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির জন্যও পরিবেশকে ঠিক রাখা জরুরি। দেশের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রণোদনা খোঁজার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভলান্টারি কার্বন মার্কেটে ট্রেডিং করে প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব। এ সময় তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআর তহবিল পরিবেশ খাতে ব্যবহারের জন্য আরণ্যক ফাউন্ডেশনকে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।’
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক ফাউন্ডেশনের হেড অব প্রোগ্রামস মাসুদ আলম খান। তিনি জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় প্রতি বছরই দেশের চার ভাগের এক ভাগ প্লাবিত হয়। এ দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা না কমাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এজন্য পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণে ব্যক্তি খাতের নিবিড় সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বিশেষ করে ইকো ট্যুরিজম, স্থানীয় জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব স্থাপন, সিএসআর কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
মূল প্রবন্ধের ওপর মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশে প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম, ওয়েল গ্রুপের সিইও সৈয়দ নুরুল, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও ওয়েন্ড সভাপতি ড. নাদিয়া বিনতে আমিন, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক এমজিআর নাসির মজুমদার, ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা, ইউনিলিভারের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শামীমা আক্তার ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সাসটেইনেবিলিটি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ম্যানেজার আহমেদ রায়হান আহসানুল্লাহ বক্তব্য দেন।
আরো বক্তব্য দেন মাটি অর্গানিকস লিমিটেডের এমডি মো. খায়রুল আলম, রিসাইক্লিং জার লিমিটেডের সিইও জিয়াউর রহমান, সিটি গ্রুপের টি এস্টেটের জেনারেল ম্যানেজার সাজাদ সারওয়ার ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হেড অব প্রজেক্ট অ্যান্ড প্রোগ্রাম রেহানা আক্তার রুমা।