ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। এ দুই শক্তির ওপর ভিত্তি করেই নেওয়া হয়েছে দেশের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা। সরকারও দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের অনুষ্ঠান পালন করেছে বেশ ঘটা করেই। মাত্র কয়েক বছর না যেতেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। তীব্র ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানিতেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাকিতে জ্বালানি আনার অনুরোধ করেও সায় মিলছে না সরবরাহের।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাওনা ৩৭ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা এবং গ্যাস বিক্রিতে পেট্রোবাংলার পাওনা তিন হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপির পাওনা ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ছয় হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা, ভারতের আদানী পাবে চার হাজার ১৪০ কোটি টাকা, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ দেনা এক হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা ৯ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বেগ পেতে হচ্ছে। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজেদের অক্ষমতার কথাও জানালেন তারা।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় দেশে চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, তখন লোডশেডিং ছিল এক হাজার ৪৯ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দেশের গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কোনো কোনো গ্রামীণ এলাকায় দৈনিক সাত থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশ ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির সংকট ও সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না থাকায় চাহিদা অনুযাযী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।

এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশংকা করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে চলমান এ সংকট শিগগিরই কাটিয়ে ওঠবে বলে আশাবাদী বিদ্যুৎ খাতের সরকার সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যে সমস্যা চলছে, তা মূলত টাকার সমস্যা। সরকারের হাতে টাকা নেই। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন তার জোগান দিতে পারছে না। এ সমস্যাটা এখন আর বিদ্যুৎ খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন মূল জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এতে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

ড. ম তামিম বলেন, ‘দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করাসহ পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে না পারলে খুব সহসাই এ পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে সংকট চলছে, তা একদিনে তৈরি হয়নি। দিনে দিনে এই সংকটকে পুঞ্জীভূত করা হয়েছে।’

এম শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা চারটা কারণে এই অবস্থা ডেকে এনেছি। একটা হচ্ছে স্পিডি অ্যাক্ট। দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন তৈরি এই খাতে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতাহীন করে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়েছে। মুনাফা অর্জনকারীদের সুযোগ বাড়িয়েছে। এই খাতে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি করেছে। এটা অন্যায়, অযৌক্তিক ও শুধু বিনিয়োগকারী ও তাদের নেপথ্যে দৃশ্য-অদৃশ্যে থাকা কমিশনভোগীরা এতে লাভবান হয়েছে। এই আইন বন্ধ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু এটা কেউ মুখেও আনছেন না।’

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলমান সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘প্রতিদিনই দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে চলেছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি। এ চাহিদার কথা চিন্তা করেই আমরা জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছি। আমরা এখন অনায়াসেই ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব উপাদান প্রয়োজন যেমন গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও কয়লা, এগুলোর জোগানে ঘাটতি রয়েছে।’

প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি জোগান দিতে যেমন সমস্যা হচ্ছে পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতেও সমস্যা হচ্ছে।’ তবে এ সমস্যা কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। সূত্র এনটিভি ।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...